|
|
|
|
সিপিএমের পাশাপাশি চক্রান্তের অভিযোগ তৃণমূলের একাংশের দিকে |
শুভেন্দুর প্রাণসংশয়, বলছে গোয়েন্দা রিপোর্ট |
নিজস্ব সংবাদদাতা • কলকাতা |
দলের অন্দরে গোষ্ঠী লড়াইয়ের জেরে তৃণমূলেরই একাংশ দলীয় সাংসদ শুভেন্দু অধিকারীকে খুনের চক্রান্ত করছে বলে রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরে রিপোর্ট দিয়েছে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার গোয়েন্দা পুলিশ। রিপোর্টে এমনও বলা হয়েছে যে, শাসকদলের একাংশ ওই বিষয়ে প্রধান বিরোধীদলের (সিপিএম) একাংশের সঙ্গে যোগসাজস রেখেছে। রিপোর্ট বলছে, ‘দলীয় অর্ন্তদ্বন্দ্বের ফলে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে তৃণমূলের কিছু প্রথমসারির নেতা ওই ঘৃণ্য কাজে মদত দিচ্ছেন’।
বুধবার রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরের এক কর্তা রিপোর্টটির (মেমো নম্বর ৮৪৫/সি) সত্যতা স্বীকারও করেছেন। বস্তুত, রিপোর্টে গোটা বিষয়টিই এমন ভাবে পরিকল্পনা করা হয়েছে, যাতে ঘটনা ঘটলে সেটিকে মাওবাদীদের কাজ বলে চালিয়ে দেওয়া যায়! যে কারণে পশ্চিম মেদিনীপুর এবং জঙ্গলমহলে যাতায়াতের সময় শুভেন্দুর নিরাপত্তায় আরও কড়াকড়ি করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে পুলিশ। পূর্ব ও পশ্চিম মেদিনীপুরের সব থানাকে সতর্কও করা হয়েছে। রিপোর্টটি পাঠানো হয়েছে দক্ষিণবঙ্গের বিভিন্ন রেঞ্জের আইজি ও ডিআইজি-দের কাছে। তৃণমূল সূত্রের দাবি, স্বরাষ্ট্র (পুলিশ) দফতরের দায়িত্ব যেহেতু স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের হাতে, তাই বিষয়টি সম্পর্কে তিনিও অবহিত।
শুভেন্দু নিজে অবশ্য ওই বিষয়ে মন্তব্য করতে চাননি। তাঁর মন্তব্য, “আমি এসব নিয়ে ভাবিত নই। আমি আমার কাজ করছি। নিরাপত্তার ব্যাপারটা যাঁদের দেখার, তাঁরাই দেখবেন।” তবে পূর্ব মেদিনীপুর জেলার এক বিধায়ক জানান, তমলুকের তৃণমূল সাংসদ বিষয়টি নিয়ে নিজে মুখ্যমন্ত্রীকে কিছু জানাননি। তবে জেলার তৃণমূল নেতৃত্ব শুভেন্দুর নিরাপত্তা নিয়ে ‘উদ্বিগ্ন’। বিশেষত, যখন পুলিশ রিপোর্টে তাঁকে হত্যার চক্রান্তে দলের একাংশের যোগসাজসের কথা স্পষ্ট উল্লেখ করা হয়েছে।
শুভেন্দুর উপর হামলার বিষয়ে প্রাথমিক রিপোর্টটি এসেছিল পূর্ব মেদিনীপুর জেলাপুলিশের মহিষাদল ‘সার্কল’ থেকে গতবছরের শেষদিকে। সেখানেই তাঁকে হত্যার চক্রান্তে তাঁর দলেরই একাংশের জড়িত থাকার আশঙ্কার কথা বলা হয়েছিল। যেমন বলা হয়েছিল, ওই ঘটনা ঘটলে তার দায় মাওবাদীদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হবে।
শুভেন্দুর নিরাপত্তা সংক্রান্ত আরও একটি রিপোর্ট ১৭ জুনই জেলা গোয়েন্দাপুলিশের তরফে রাজ্য স্বরাষ্ট্র দফতরে পাঠানো হয়েছে। তাতে বলা হয়েছে সাম্প্রতিকতম গোয়েন্দা রিপোর্ট বলছে, তমলুকের সাংসদকে অপহরণের আশঙ্কা রয়েছে। আপাতত শুভেন্দু ‘জেড ক্যাটিগরি’র নিরাপত্তা পান। যাতায়াতের পথে তাঁকে অপহরণের চেষ্টা করা হবে বলে গোয়েন্দা রিপোর্টে (দু’টি রিপোর্টই আনন্দবাজারের হেফাজতে রয়েছে) বলা হয়েছে। যে কারণে শুভেন্দুর যাতায়াতের পথে ও গন্তব্যে আগে থেকে ‘সেফ-হাউস’ এবং হাসপাতালে বেড ‘বুক’ করে রাখার সিদ্ধান্ত হয়েছে।
শেষ রিপোর্টটিতে বলা হয়েছে, শুভেন্দুকে অপহরণের চেষ্টা করবে সিপিআই (মাওবাদী) ও তাদের বিভিন্ন গণ সংগঠনগুলি। যা, প্রথম রিপোর্টটির প্রেক্ষিতে ‘তাৎপর্যপূর্ণ’ বলে মনে করছে জেলার রাজনৈতিক মহল। দলের এক প্রথমসারির নেতার কথায়, “বিষয়টি উদ্বেগজনক তো বটেই, আরও উদ্বেগজনক এই কারণে যে, এর সঙ্গে দলেরই একাংশের জড়িত থাকার কথা উল্লেখ করা হচ্ছে। দ্বিতীয় রিপোর্টটি সেই কারণেই চিন্তার। কারণ প্রথম রিপোর্টেই বলা হয়েছিল, আচমকা কোনও দুর্ভাগ্যজনক ঘটনা ঘটলে তা মাওবাদীদের নামে চালিয়ে দেওয়া হবে!”
তৃণমূলে গোষ্ঠী লড়াই নতুন কিছু নয়। বস্তুত, সিপিএমকে বিপুল ভোটে হারিয়ে জয়ের পর তা রাজ্যের বিভিন্ন জায়গায় নতুন মাত্রা পেয়েছে। ক্ষমতা দখলের লড়াই ঘিরে তৃণমূলের মধ্যেই গোলমাল ও আক্রমণ, প্রতি-আক্রমণের ঘটনা ঘটছে। তবে তা মূলত ‘তৃণমূল’ স্তরেই সীমাবদ্ধ। কিন্তু শুভেন্দুর মতো দলের একজন প্রথমসারির সাংসদের বিরুদ্ধে দলেরই একাংশের চক্রান্তের যে খবর পুলিশের রিপোর্টে উঠে এসেছে, তার নজির সাম্প্রতিক কালে নেই।
নন্দীগ্রাম-কাণ্ডের পর শুভেন্দুর যে ‘উত্থান’ রাজনীতিতে হয়েছিল, অনেকটা তার উপর ভর করেই জমি-আন্দোলনকে সামনে রেখে স্বয়ং মমতা তথা তৃণমূলেরও ‘রাজনৈতিক পুনর্জন্ম’ হয়। যার ফলে প্রথমে পঞ্চায়েত, পরে লোকসভা ও সবশেষে বিধানসভায় নিরঙ্কুশ ক্ষমতা দখল করে তৃণমূল। মমতা শুভেন্দুকে তৃণমূল যুব কংগ্রেসের রাজ্য সভাপতি পদে নিয়োগ করেন। প্রকাশ্যেই তমলুকের সাংসদকে ‘নন্দীগ্রামের নায়ক’ বলে অভিহিত করা হতে থাকে।
তৃণমূলের অন্দরে তখন থেকেই একটি ‘শুভেন্দু-বিরোধী’ গোষ্ঠী তৈরি হয়। একটা সময়ে মমতাও শুভেন্দুর উপর খুব একটা ‘তুষ্ট’ ছিলেন না। শুভেন্দু-ঘনিষ্ঠদের অভিযোগ, দলেরই এক সাংসদের কথায় শুভেন্দুর উপর ‘রুষ্ট’ হন দলনেত্রী। পরবর্তীকালে শুভেন্দু আবার মমতার ‘আস্থাভাজন’ হন। কিন্তু অতি সম্প্রতি হলদিয়ার পুরভোটে তৃণমূলের ‘অপ্রত্যাশিত’ হারের পর শুভেন্দু আবার দলের একাংশের তোপের মুখে পড়েন। নেত্রী অবশ্য তাঁর ‘পাশে’ থাকার কথা শুভেন্দুকে জানিয়েছেন। কিন্তু শুভেন্দু-অনুগামীদের বক্তব্য, এখনও তাঁর ‘উত্থান’ মানতে পারছেন না দলের একাংশ। তৃণমূলের এক বিধায়কের বক্তব্য, “দলে ব্যক্তিত্বের সঙ্ঘাত হয়েই থাকে। কিন্তু তাতে শত্রুশিবিরের সঙ্গে যোগসাজস করে কেউ দলের নেতাকে খুনের চক্রান্ত করছে এটা অভাবনীয়! আমাদের আশা, মুখ্যমন্ত্রী তথা পুলিশমন্ত্রী বিষয়টিতে উপযুক্ত গুরুত্ব দেবেন।” |
|
|
|
|
|