মন্দার বাজারে সব দেশ মিলে এক সঙ্গে ব্যয়সঙ্কোচ কাজের কথা নয়। বরং পরিস্থিতি অনুযায়ী বৃদ্ধি-সহায়ক অবস্থান নিতে হবে। আর্থিক মন্দা কাটাতে জি-২০র বৈঠকে এমনই দাওয়াই দিলেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। সেই দাওয়াই মেনেও নিয়েছে বিশ্বের প্রধান কুড়িটি দেশের জোট। লস কাবোসের চূড়ান্ত ঘোষণায় সর্বসম্মতিক্রমে বলা হয়েছে, যে সব দেশের বাজেট ঘাটতি নেই বা যাদের উদ্বৃত্ত রয়েছে, তারা যেন এই সঙ্কটের পরিস্থিতিতে ব্যয়সঙ্কোচের পথে হেঁটে নিজেদের গুটিয়ে না নেয়।
অর্থনীতিবিদ মনমোহনের এই সাফল্যের পাশাপাশি আজ সাফল্য কুড়িয়েছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহনও। ঘরোয়া অর্থনীতিকে বৃদ্ধির পথে ফেরাতে এ বারের জি-২০ শীর্ষ সম্মেলন থেকে বড় ধরনের প্রতিশ্রুতি আদায় করে নিলেন তিনি। নয়াদিল্লির দীর্ঘ ও ধারাবাহিক চাপের পর সম্মেলনের চূড়ান্ত প্রস্তাবের প্রিঅ্যামবেলেই বলা হল, “উন্নয়নশীল দেশে পরিকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ বাড়াতে জি-২০র সদস্য দেশগুলি তৎপরতা আরও জোরালো করবে।” সে জন্য শক্তিশালী করা হবে আইএমএফ, বিশ্বব্যাঙ্ক, এডিবি-র মতো আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলিকেও। সেখানে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশের অংশীদারিত্ব বাড়ানোও হবে (দীর্ঘদিন ধরে এই দাবি জানিয়ে আসছিল নয়াদিল্লি)। এই প্রতিশ্রুতি বাজারকে উজ্জীবিত করবে বলেই আশা করা হচ্ছে। |
জি-২০-তে এ বার পেট্রোপণ্যের দামের ওঠাপড়ার বিষয়টিও গুরুত্ব পেয়েছে। সাম্প্রতিক কালে এই একটি বিষয়ে ঘরোয়া রাজনীতিতে বারবার আক্রমণের মুখে পড়তে হয়েছে সরকারকে। আর তাই তেলের দামের স্থিতিশীলতার জন্য এ বার গোড়া থেকেই দাবি জানিয়ে আসছিল নয়াদিল্লি। শেষমেশ আজ চূড়ান্ত গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছে, তেলের চাহিদা অনুযায়ী যাতে জোগান অব্যাহত থাকে, সে জন্য উৎপাদনকারী দেশগুলির ওপর চাপ রাখবে জি-২০। সেই সঙ্গে তেলের দামের ওঠাপড়া রুখতে কড়া নজর রাখবে।
জি-২০ সম্মেলন থেকে নয়াদিল্লির বহু আকাঙ্ক্ষিত এই সব ফসল ঘরে তুলে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “লস কাবোসের ঘোষণায় উন্নয়নশীল দেশগুলির দীর্ঘদিনের দাবিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। (ভারতের মতো) উন্নয়নশীল দেশগুলিতে পরিকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ যেমন তাদের বৃদ্ধির সহায়ক হয়ে উঠবে, তেমনই বিশ্ব অর্থনীতিকেও চাঙ্গা করবে। জি-২০র এই প্রতিশ্রুতিকে সুনির্দিষ্ট ভাবে বাস্তবায়িত করার জন্য নয়াদিল্লি কাজ চালিয়ে যাবে।”
তবে জি-২০র এই প্রতিশ্রুতির সমান্তরালে প্রধানমন্ত্রীর সামনে বৃহত্তর চ্যালেঞ্জও রইল বলে মনে করা হচ্ছে। তা হল, দেশে পরিকাঠামো উন্নয়নে রাজনৈতিক ও অন্যান্য বাধা দ্রত কাটানো। এবং তার মধ্যে দিয়ে বিনিয়োগের অনুকূল বাতাবরণ তৈরি করা। প্রধানমন্ত্রীর সচিবালয়ের কর্তাদের বক্তব্য, সেই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এরই মধ্যে নেমে পড়েছেন মনমোহন। দ্বাদশ যোজনায় পরিকাঠামো উন্নয়নে এক লক্ষ কোটি ডলার বিনিয়োগের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। এর ৭০% পূরণ হলে দেশ ৮ থেকে ৯% বৃদ্ধির পথে অনায়াসে ফিরতে পারবে বলে তিনি আশাবাদী।
তবে লস কাবোসে বসেই প্রধানমন্ত্রী জানতে পেরেছেন যে, ইউরো জোনের সঙ্কটমোচনের জন্য দিল্লি হাজার কোটি ডলার দেওয়ার অঙ্গীকার করায় ঘরোয়া রাজনীতিতে কোনও কোনও অংশ থেকে সমালোচনাও হচ্ছে। এ-ও বলা হচ্ছে যে, ঘরোয়া অর্থনীতিই যখন প্রায় মুখ থুবড়ে পড়েছে তখন ইউরোপের জন্য এত উদারতা কোন সাহসে দেখাচ্ছে সরকার! আজ সম্মেলন শেষে প্রধানমন্ত্রী সেই বিষয়টি তাই ব্যাখ্যা করতে তৎপর হন। তাঁর কথায়, “ইউরো জোনের অর্থসঙ্কট মোকাবিলায় নয়াদিল্লির এই অঙ্গীকার থেকে এটাই প্রমাণিত হয় যে, ভারত এখন বিশ্বের অন্যতম দায়িত্বশীল দেশ। তা ছাড়া অঙ্গীকার করা মানে এই নয় যে, এখনই টাকাটা দিয়ে দেওয়া হচ্ছে। ওই টাকা আপাতত ভারতের অর্থ ভাণ্ডারেই থাকবে। ইউরোপে আপৎকালীন পরিস্থিতি হলে তারা সেই অর্থ নিতে পারবে।”
তবে এ সবেরই মাঝে ভারতের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলিতে বৃদ্ধির হার কমে যাওয়ার বিষয়টি নিয়েও এ বার জি ২০ শীর্ষ সম্মেলনে আলোচনা হয়েছে। তবে সে জন্য জেনেবুঝেই সমালোচনার সুর রাখা হয়নি চূড়ান্ত প্রস্তাবে। এই ভেবে যে তাতে সেই সব দেশে বিনিয়োগের ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে। বরং বলা হয়েছে, বৃদ্ধির হার বাড়াতে এই দেশগুলি যথাযথ আর্থিক ব্যবস্থা নিচ্ছে। |