কাঁটাতার আছে মাঝখানে। কিন্তু পাখি কাঁটাতার মানবে কেন?
বাল্যস্মৃতিও কি তা মানে?
এ বঙ্গের পাঠক তাঁকে পড়ছেন অনেক দিন থেকেই। ও বঙ্গ থেকে উড়ে এসে আনন্দ পুরস্কার নিয়ে গিয়েছে তাঁর ‘আগুনপাখি’। এ বার বর্ধমানের মঙ্গলকোটে ফের নিজের ছেলেবেলা ছুঁতে এলেন হাসান আজিজুল হক।
এই প্রথম নয়। আগেও এসেছেন। শেষ বার এসেছিলেন ২০০৮-এ, আনন্দ পুরস্কার নিয়ে। কিন্তু সপরিবার এই প্রথম। মঙ্গলকোটের যবগ্রামেই তাঁর জন্ম, বেড়ে ওঠা। নিজেদের ভিটে আর নেই। স্ত্রী-ছেলেমেয়ে-নাতি নিয়ে উঠেছেন আত্মীয়ের বাড়িতে।
“১৯৬০ পর্যন্ত আমি ভারতেরই নাগরিক ছিলাম। তার পর পাকাপাকি ও পারে” সত্তরোর্ধ্ব লেখকের কথায় ফিরে আসতে থাকে সেই দিনগুলো। আঙুল তুলে দেখান “ওই যে স্কুল, ওখানেই আমার পড়াশোনা। ওই স্কুল থেকেই ম্যাট্রিক দিই। সেটা ১৯৫৪ সাল। তার পরেই চলে গেলাম পুব বাংলায়।”
তাঁর সেই স্কুল, সেই মহারানি কাশীশ্বরী বিদ্যালয়ের প্রথম ছাত্রী ছিলেন আজিজুলের দিদি জাহানারা বেগম। খুলনার দৌলতপুর ব্রজলাল কলেজের ইংরেজি শিক্ষক মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে বিয়ের পরে তিনি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে (তখনও বাংলাদেশ হয়নি) চলে যান। ম্যাট্রিক পাশের পরে তাঁদের ডাকেই ও পারে
যান আজিজুলও। |
কিন্তু সে যাওয়া একেবারে চলে যাওয়া নয়। রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতক হয়ে অস্থায়ী শিক্ষক হিসেবে ফিরে আসেন নিজের স্কুলেই। “তৎকালীন স্কুল পরিদর্শক প্রথমে আমায় বেতন দিতে চাননি। যুক্তি দিয়ে বোঝানোর পরে ১৩৫ টাকা বেতন দেওয়া হত” বলতে বলতে হেসেই ফেলেন রাজশাহি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অবসর নেওয়া দর্শনের অধ্যাপক। স্কুলে ঢুকতেই কচিকাঁচারা ঘিরে ফেলে তাঁকে। তারা হাসে। তিনিও হাসতে থাকেন। হাসতে থাকে চেনা দরজা, দেওয়াল, ক্লাসঘরগুলোও।
হঠাৎই নজর যায় স্কুলের পুকুরে। “এর নাম ঘোলা পুকুর। এখন তো শুধু কঙ্কাল পড়ে আছে। আগে কুড়ি-তিরিশ কিলোর রুই-কাতলা উঠত। খুব পানিফল হত। সাঁতার দিয়ে পানিফল নিয়ে আসতাম। বাজি ধরে পারাপার করতাম।” রাস্তার পাশে ডোবা দেখে মনে পড়ে যায় “ছিপ ফেলে মাছ ধরতাম এখানে। আর ওই যে একটা মাঠ আছে, ওখানে ফুটবল খেলতাম। ছিলাম ব্রাজিলের সমর্থক। মারাদোনা আসার পরে হয়ে গেলাম আর্জেন্তিনার। পরে আবার ব্রাজিলের। এখন ফের মেসির জন্য আর্জেন্তিনা!” শিশুর উচ্ছ্বাস ছড়িয়ে পড়ে দুই চোখে।
রাস্তায় হঠাৎ দেখে পাড়া-পড়শি কেউ এসে জড়িয়ে ধরছেন, কেউ হাত মেলাচ্ছেন। ‘ভাল আছ তো?’ জানতে চাইছেন কেউ। পথে পড়ল পিরবাবার আস্তানা। তার পাশে ছোট চালাঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়েন বৃদ্ধ। “এই ঘরে আমার ছোটবেলা কেটেছে। পাশে ‘মোল্লাভবন’ আমাদের পুরনো বাড়ি। মুসলিমরা পিরবাবার আস্তানার রক্ষাকর্তা হলেও এখানে আসতেন মূলত হিন্দুরাই। আমার সবচেয়ে প্রিয় বন্ধুও হিন্দুই। সমরেশ নন্দী। এ বার সবাইকে য়ে ওর বাড়ি যাব।”
সমরেশবাবুর বাড়ি স্কুলের কাছে। তাঁর মনে পড়ে, রাতভর গল্প করবেন বলে কী ভাবে লুকিয়ে বাড়িতে ঢুকত বন্ধু। বলেন, “ও তো শুধু আমার বন্ধু ছিল না। শিক্ষকও ছিল। ওর সংস্পর্শে না থাকলে আমার মতো অনেকেরই ম্যাট্রিকের গণ্ডি পেরনো হতো না।”
দেশ বদলে গিয়েছে। কাঁটাতার পেরিয়ে বন্ধু চলে গিয়েছেন রাজশাহি। কিন্তু তাঁর মন এখনও ঘুরে বেড়ায় মঙ্গলকোটের যবগ্রাম, ক্ষীরগ্রাম, নিগন, কোশিগ্রামে। গল্পের মানুষেরা ভেসে বেড়ায় এ পারের মাঠে-বাটে।
জামার হাতা ধরে টান দেয় কাঁচা বয়সের দিনগুলো। |