|
|
|
|
তুরুপের তাস, মহাকাশে |
নম্র, অনুগত, খেটে খাওয়া। এবং কমিউনিস্ট। ঠিক তেমন মেয়ে তিনি। অতএব ১৬ জুন,
১৯৬৩, মহাকাশে গেলেন প্রথম নারী। ভালেন্তিনা তেরেশকোভা। অনির্বাণ ভট্টাচার্য |
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হয়েছে মাত্র ক’বছর। আগেকার মহারথীরা মানে মানে অস্ত গিয়েছেন। মূল মঞ্চে মাইক বাজছে আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়ন-এর। হাতে নতুন মাস্তানি এলে যা হয়, তাই হল এ বার, এলাকা ভাগ। এ বলে আমায় দেখ, তো ও বলে আমায়। কিন্তু একে অপরকে কেউ সরাসরি কিছুই বলছিল না। বললে আর লড়াইটা ঠান্ডা থাকবে কী করে? ফলত, চিঁড়ে-চ্যাপ্টা অবস্থা, এলাকার শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ভাইসকলের।
এই মার দিয়া কেল্লা অ্যাটিটিউড প্রকৃত অর্থে গগনে উঠল, যখন সোভিয়েত ইউনিয়ন ১৯৬১ সালে ভস্তক -১ স্পেস শাটল-এ চাপিয়ে য়ুরি গাগারিনকে মহাকাশে পাঠাল। আমেরিকাও উঠে পড়ে লেগেছিল, শেষ ল্যাপ-এ মার খেয়ে গেল। কিন্তু তারা যে পিছু ছাড়েনি, তা রাশিয়া ভাল বুঝল, যখন আমেরিকা তিন সপ্তাহের মধ্যে অ্যালান শেপার্ডকে মহাকাশে পাঠাল। রাশিয়া দেখল, এ বেলায় রান রেট বাড়িয়ে না রাখলে, পরে বিপদ। অতএব চাই একটা ব্লকবাস্টার।
সেই ব্লকবাস্টার-এর নামই হল ভালেন্তিনা ভ্লাদিমিরোভনা তেরেশকোভা। পৃথিবীর প্রথম মহিলা মহাকাশ অভিযাত্রী। ১৬ জুন, ১৯৬৩ হ্যাঁ, ঠিক আজকের দিনটিতেই ভস্তক-৬-এ চড়ে ভালেন্তিনা আমাদের জেনারেল নলেজ-এ ঢুকে পড়েছিলেন।
কথাগুলো এই ভাবে বলার মধ্যে যদি কোনও খোঁচা দেখতে পান, তবে ঠিক দেখছেন। কিন্তু সেটা কোনও মতেই ভালেন্তিনার প্রতি নয়, তাঁর দেশের রাষ্ট্রযন্ত্রটির প্রতি। তাঁকে যে ভাবে প্রোপাগান্ডার বোড়ে হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল, তার প্রতি। গাগারিনকে মহাকাশে পাঠানোর কয়েক দিনের মধ্যেই রাশিয়ান কসমোনট চিফ, কামানিন ঠিক করেছিলেন, তাঁদের পরবর্তী আকর্ষণ হওয়া উচিত, এক জন মহিলাকে মহাকাশে পাঠানো। অতএব খোঁজ খোঁজ, সেই অসামান্যা’র। যাঁর বয়স হবে ৩০-এর নীচে, ১৭০ সেন্টিমিটার-এর কম হাইট, ওজন ৭০ কে.জি’র মতো বা কম, অন্তত পাঁচ-ছ’মাসের প্যারাশুট ট্রেনিং থাকতে হবে, চরিত্র হবে প্রায় ধোয়া তুলসী পাতার মতো আর হ্যাঁ, হতেই হবে কট্টর কমিউনিস্ট।
পাইলট হওয়া জরুরি ছিল না, কারণ ভস্তক স্বয়ংক্রিয় যান ছিল, অতএব এতে যে যাবে, সে প্যাসেঞ্জার মাত্র। তবে প্যারাশুটিং জানা আবশ্যক ছিল, কারণ পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে ঢোকার পর, যাত্রীকে সঙ্গে নিয়ে অবতরণ করার ক্ষমতা ভস্তক-এর ছিল না, তাঁকে প্যারাশুট করে আলাদা নামতে হত। ভালেন্তিনা এটি মোটামুটি ভালই পারতেন। তাই প্রাথমিক তালিকায় ঢুকে পড়তে তাঁর বিশেষ অসুবিধে হল না। সঙ্গে আর যাঁরা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে সোলোভায়োভা, পোনোমারিয়োভা বা কুজনেত্সোভা অনেক বেশি যোগ্য ছিলেন। কেউ টেস্ট পাইলট, কেউ ইঞ্জিনিয়ার বা বিশ্বমানের প্যারাশুটিস্ট, কিন্তু তা-ও, শুরু থেকেই ক্রেমলিন-এর নজরে শুধুই ভালেন্তিনা তেরেশকোভা। কেন?
কারণ তাঁর ইমেজ। মাসলেনিকোভো নামক ছোট্ট শহরে জন্মের পর থেকেই ভালেন্তিনাকে লড়াই করতে হয়েছিল। ওঁর যখন দু’বছর বয়স, তখন ভালেন্তিনার বাবা ভ্লাদিমির, ফিনো-রাশিয়ান যুদ্ধে নিখোঁজ হয়ে যান। সেই থেকে সংসারের হাল ধরেন মা এলেনা। ছোট্ট ভালেন্তিনা প্রথম স্কুলে যায় আট বছর বয়সে। কিন্তু টানের সংসারে কি অত কিছু চলে? ১৭-য় পড়ামাত্রই স্কুল-টুল ছেড়ে তিনি কাজে লেগে যান একটি সুতোকলে। কিন্তু এ মেয়ে সহজে দমে যাওয়ার নয়। পড়াশোনা চলতে লাগল করেসপন্ডেন্স কোর্সে। শুরু হল স্কাই-ডাইভিং শিক্ষাও। আর এই সবের পাশাপাশি, ভালেন্তিনার টিন-এজ মন ভরে যাচ্ছিল কমিউনিজম-এর লাল রঙে।
|
|
ছবি: সুমন চৌধুরী |
ঠিক এমন কাউকেই তো তন্ন তন্ন করে খুঁজছিল প্রশাসন। যাকে পৃথিবীর সামনে তুলে ধরে বলা যাবে, দেখ এই হল প্রকৃত স্ত্রীশক্তি, এই হল সেই নারী, যে সব্বাইকে হেলায় ছাড়িয়ে ওপরে উঠে যেতে পারে। আর সেই নারী কেমন? না, নম্র, অনুগত, খেটে খাওয়া মধ্যবিত্ত, ফলে লড়াকু, আর অবশ্যই রুশ ও কমিউনিস্ট। ভালেন্তিনা ছিলেন এই সব। এবং শারীরিক দিক দিয়ে বেশ ফিট। অতএব ওয়েটলেস ফ্লাইট, প্যারাশুট জাম্প, আইসোলেশন টেস্ট, সেন্ট্রিফিউজ টেস্ট দিব্যি
উতরে গেলেন। রকেট থিয়োরি বা স্পেস ক্রাফ্ট ইঞ্জিনিয়ারিং বুঝতে বেগ পেতে হল ঠিকই, কিন্তু আশা ছাড়লেন না। শিক্ষার অভাবকে আবেগ ও নিষ্ঠা দিয়ে কেটে ফেলার লড়াই চালিয়ে গেলেন। এবং সেটা স্পষ্ট হল, ফাইনাল ইন্টারভিউ-এ।
সেই চরম পর্বে টক্কর হল পোনোমারিয়োভা ও তেরেশকোভার মধ্যে। দীর্ঘ ট্রেনিং-এর পর যে সব টেস্ট হয়, শুধু সেগুলো ধরলে, পোনোমারিয়োভা ধরাছোঁয়ার বাইরে। কিন্তু দেশটার নাম তো সোভিয়েত ইউনিয়ন। পোনোমারিয়োভাকে প্রশ্ন করা হল: তুমি জীবন থেকে কী চাও? উত্তর এল: আমি জীবন থেকে যা যা সম্ভব, সব তুলে নিতে চাই, ভোগ করতে চাই দু’হাত ভরে... আর তেরেশকোভা, তুমি? আমি চাই সর্বশক্তিমান কমিউনিস্ট পার্টি...
এই উত্তরের পর আর কি বুঝতে বাকি থাকে, কে মহাকাশে যাবে আর কে শুধুই গ্রুপ ফোটোগ্রাফে পাশে দাঁড়াবে? ১৬ জুন ১৯৬৩ সালে, ভালেন্তিনা উড়ে গেলেন আকাশে। সোভিয়েত ইউনিয়ন পেয়ে গেল তার ব্লকবাস্টার। দেখিয়ে দিল, সারা পৃথিবী জুড়ে যা ইচ্ছে হোক, রাশিয়ায় পুরুষ-নারী কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে এক বচন।
সত্যি নাকি? ভালেন্তিনা যখন মহাকাশ থেকে বলছেন, ও মা, ওটা কী? ওই হালকা নীল রঙের ব্যান্ডটা? ওটাই পৃথিবী! টেলিভিশনে যখন দেখা যাচ্ছে, ভালেন্তিনা হাসছেন প্রাণ ভরে আর তাঁর মুখের সামনে ভেসে বেড়াচ্ছে পেনসিল, লগ বুক, তখন পৃথিবী জুড়ে উল্লাসের হাওয়া বইলেও, সোভিয়েত প্রশাসনের মুখে ছিল শুধুই নিজেদের প্রশংসা, আর ভালেন্তিনার প্রতি সাইবেরিয়ার শীতের মতো ঠান্ডা তাচ্ছিল্য। ভাবখানা এমন যেন, অত লাফালাফির হয়েছেটা কী, আমরাই তো ধরে উড়িয়ে দিলাম মেয়েটাকে!
মহাকাশে ৭০ ঘন্টা ৫০ মিনিট কাটানোর মধ্যে, বেশ কিছু ব্যাঘাতও এসেছিল। যেমন প্রথম দিনই ভালেন্তিনা বমি করে ফেলেন। সোভিয়েত বায়ু সেনা-র চিফ ডিজাইনার কোরোলেভ, বিরক্ত হয়ে তাঁকে নামিয়ে আনতে চেয়েছিলেন। ভালেন্তিনা পরে জানিয়েছিলেন, স্পেস-সিকনেস-এর জন্য অমনটা হয়নি, যে খাবার দেওয়া হয়েছিল, সেটি শুকিয়ে অখাদ্য হয়ে যাওয়ার ফলেই, ওই বমি। কিন্তু প্রশাসন তা মানেনি, অতএব তাঁকে চুপ করে এক জায়গায় বসে থাকার নির্দেশ দেওয়া হয়েছিল। এর ফলে ভালেন্তিনার পায়ে অসহ্য ক্র্যাম্প ধরে যায়। মিশন শেষেও ঝঞ্ঝাট। প্যারাশুট করে তিনি নামছেন, দেখা গেল, একটি বিরাট হ্রদে পড়বেন। খিদেয়, তেষ্টায়, ক্লান্তিতে তাঁর চোখ বুজে আসছিল। সাঁতরে পার হওয়ারও জোর ছিল না। কিন্তু একটি দমকা হাওয়া তাঁকে শেষমেষ ডাঙায় নিয়ে গিয়ে ফেলে। আর তার ফলে, নাকে ভাল রকম কালশিটে পড়ে যায়।
কিন্তু তখন কি আর যন্ত্রণা মেনে নেওয়ার সময়? মহাকাশে আর কতই বা কন্ট্রোল করা যায়, কিন্তু এখন তো ভালেন্তিনা মাটিতে, আবার কব্জায়। অতএব বলা হল: যাও, ক্লান্তিফান্তি ঝেড়ে, মেক-আপ লাগিয়ে, হাসিমুখে জয়গান গাও। সারা পৃথিবী দেখছে না! এই সারা ক্ষণ সব কিছু নিয়ন্ত্রণ করে যাওয়াই তো কমিউনিস্ট রাষ্ট্রের ধর্ম।
হ্যাঁ, ভালেন্তিনা রাষ্ট্রের তালে তালে পা মিলিয়েছিলেন। কিন্তু শুধুই কি সেই জোরে কেউ এত উপরে উঠতে পারে? সারা পৃথিবীকে যা দেখানো হচ্ছিল, তা যে সত্যিই তেমন না, সেটা তিনি জানতেন। আর এখানেই তো আসল লড়াই। সিস্টেম-এর বিরুদ্ধে না গিয়ে, কোনও বেমক্কা কথা না বলে, নিজের জাত চিনিয়ে নেওয়ার লড়াই। নিজেকে পরিস্থিতির শিকার ভেবে ফেলা সহজ ছিল, কিন্তু ভালেন্তিনা তা করেননি। নিজেকে কোনও ভাবে গুলিয়ে ফেলেননি। বার বার মনে করিয়ে দিয়েছেন, কী করে ও জায়গায় গেলাম-এর চেয়েও বেশি জরুরি, ওখানে গিয়ে কী করলাম। ইতিহাসের মূল চ্যাপ্টার কিন্তু লেখা হয়, ওখানে গিয়ে কী করলাম, তা-ই নিয়ে। |
|
|
|
|
|