মিশরে আরব বসন্তের দখিনা বাতাসের পথ রোধ করিয়া দাঁড়াইয়াছে সেখানকার সুপ্রিম কোর্ট। এই কোর্ট মিশরের প্রথম অবাধ নির্বাচনের মধ্য দিয়া গঠিত পার্লামেন্টকে খারিজ করিয়া দিয়াছে এবং প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে প্রাক্তন স্বৈরাচারী হোসনি মুবারকের প্রধানমন্ত্রী আহমদ শফিকের প্রার্থীপদ বৈধ বলিয়া রায় দিয়াছে। প্রশ্ন উঠিয়াছে, নির্বাচিত মুসলিম ব্রাদারহুডকে কোণঠাসা করিয়া মুবারক জমানার স্বৈরাচারীদের ফিরাইয়া আনাই কি মিশরীয় সুপ্রিম কোর্টের অভিপ্রায়? গণতন্ত্রীরা এই পদক্ষেপকে খিড়কির দরজা দিয়া প্রতিক্রিয়াশীল সামরিক অভু্যত্থানের ঘটনা রূপে বর্ণনা করিয়াছেন। অনেকেরই আলজিরিয়ার ঘটনাক্রমের কথা মনে পড়িয়া যাইতেছে এবং তাঁহারা কায়রোর সিঁদুরে মেঘের লক্ষণ দেখিতেছেন।
আলজিরিয়ায় ইসলামপন্থীরা অবাধ নির্বাচনে বিপুল গরিষ্ঠতা লইয়া জয়লাভ করিলে সামরিক জুন্টা মৌলবাদকে রুখিবার অজুহাতে সেই নির্বাচনকে অবৈধ ঘোষণা করিয়া তাহার ফলাফলকে খারিজ করিয়া দেয় এবং নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের কারারুদ্ধ করিয়া ক্ষমতা দখল করিয়া বসে। মিশরের পার্লামেন্ট নির্বাচনে গরিষ্ঠসংখ্যক আসন ইসলামপন্থী মুসলিম ব্রাদারহুড ও সালাফিরা দখল করিয়া লওয়ায় গদিচ্যুত মুবারকের প্রশ্রয়পুষ্ট জেনারেল ও বিচারপতিরা সমবেতভাবে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ক্ষমতারোহণ ঠেকাইতে মরিয়া হইয়া ময়দানে অবতীর্ণ। কয় দিন আগে এই বিচারপতিরাই সেনাবাহিনীকে যথেচ্ছ প্রতিবাদীদের গ্রেফতার করার একতরফা অধিকার দিয়াছে। স্বৈরাচার মিশরে এত দীর্ঘ কাল কায়েম থাকিয়াছে যে, কায়রোর তাহরির স্কোয়ারের মাত্র ১৮ দিনের আন্দোলনে তাহার মূল মিশরের জনসমাজ, প্রশাসন ও ক্ষমতা-কাঠামো হইতে নির্মূল হওয়ার নয়। তা ছাড়া, জুঁই বিপ্লবের যাবতীয় সুফল মিশরে সেনাবাহিনীই দখল করিয়া লয়, তাহারাই হইয়া ওঠে নির্বাচিত সরকারের হস্তে ক্ষমতা অর্পণ না-করা অবধি দেশবাসীর দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। নির্বাচিত পার্লামেন্টের হাতে শাসনক্ষমতা তুলিয়া দিবার পরিবর্তে জেনারেলরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচন পর্যন্ত অপেক্ষা করিতে মনস্থ করেন। আর তাহাতেই স্বৈরাচারের সদ্য ক্ষমতাচ্যুত কায়েমি স্বার্থচক্রীরা হৃত আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠা করার সুযোগ পাইয়া যায়। সুপ্রিম কোর্টের রায়ের মধ্য দিয়া সেই পুনঃপ্রতিষ্ঠার প্রয়াসই প্রতিফলিত। মুসলিম ব্রাদারহুড ইসলামপন্থী হউক বা না-হউক, জনসাধারণ অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচনে সেই দলের প্রার্থীদের প্রতি তাঁহাদের আস্থা ও ভরসা ন্যস্ত করিয়াছেন। তাঁহাদের শাসন করার অধিকার হইতে বঞ্চিত করার নৈতিকতা সুপ্রিম কোর্টের থাকিবে কেন?
মিশরের জনসাধারণ অত সহজে দমিবার পাত্র নন। তাঁহারা জানেন, বড় অল্প ক্ষতি, রক্তপাত ও আত্মত্যাগে মুবারক জমানার অবসান হইয়াছে। স্বৈরাচারকে উৎখাত করিয়া গণতন্ত্রকে শাখা বিস্তারের সুযোগ করিয়া দিতে আরও অনেক বলিদানের প্রয়োজন হইবে। সে জন্য তাঁহারা প্রস্তুতও। তাহরির স্কোয়ারের প্রতিবাদ ও আন্দোলন তাই এখনও প্রত্যাহৃত হয় নাই, বরং শীর্ষ আদালতের সর্বশেষ রায়ের পর তাহা নূতন করিয়া প্রজ্বলিত হইবে। মিশরের বর্তমান শাসনব্যবস্থায় অন্তত চার শত আমলা-অফিসার-সেনাধ্যক্ষ-রাজনীতিক রহিয়াছেন, যাঁহারা মুবারক জমানা ফিরাইতে বদ্ধপরিকর। কার্যকর ক্ষমতা, সেনাবাহিনী, রাষ্ট্রযন্ত্রের যাবতীয় উপকরণ, পুলিশ-নিরাপত্তা রক্ষী-গোয়েন্দা বাহিনী সবই তাঁহাদের হস্তগত। গণতান্ত্রিক বিপ্লবের লক্ষ্য ও অভীষ্ট তাই মিশরে এখনও অনর্জিত। জন-আন্দোলনের প্রাসঙ্গিকতা ও অপরিহার্যতা তাই এখনও বিদ্যমান। এখনও তাহরির স্কোয়ার খালি করিয়া যে-যাহার ঘরে ফিরিয়া যাওয়ার সময় আসে নাই, নিশ্চিন্ত নিরুপদ্রবে গণতন্ত্র অনুশীলনের লগ্ন এখনও অনাগত। মিশরকে আরও কিছু কাল তাহার অতন্দ্র প্রহরা জাগ্রত রাখিতে হইবে। |