|
|
|
|
দিদি বলেছিলেন, ঘোড়া কেন, রাষ্ট্রপতিই হবি |
দেবব্রত ঠাকুর • কলকাতা |
তিনি পরজন্মে ‘রাষ্ট্রপতির ঘোড়া’ হতে চেয়েছিলেন। আপত্তি জানিয়েছিলেন দিদি। বলেছিলেন, রাষ্ট্রপতির ঘোড়া হবি কেন, রাষ্ট্রপতিই হবি। আর সেটা এ জন্মেই।
চার দশক পরে দিদির সেই আপ্তবাক্য এ ভাবে ‘ফলে যাওয়ায়’ চোখ ছলছল অন্নপূর্ণা বন্দ্যোপাধ্যায়ের। পরবর্তী রাষ্ট্রপতি পদের প্রধান দাবিদার, প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বড় দিদি।
গত কয়েক দিন বড়ই উৎকণ্ঠায় কেটেছে দিদির। যিনি অল্পই টিভি দেখেন, কখনও বা দেখেন না, তিনিই গত কয়েক দিন বার বার চোখ রেখেছেন টিভির পর্দায়। আজ বিকেলে, ইউপিএ বৈঠকের পর সনিয়া গাঁধী যখন প্রণববাবুর নাম রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী হিসেবে ঘোষণা করলেন, তখন আর চোখের জল বাঁধ মানেনি। আনন্দাশ্রু।
কিন্তু ঘোড়ার গল্পটা কী?
দিদি বললেন, সালটা ১৯৬৯-৭০ হবে। পল্টু (প্রণববাবুর ডাক নাম) তখন সদ্য রাজ্যসভার সাংসদ হয়েছেন। বাংলা কংগ্রেস থেকে। নতুন সাংসদরা দিল্লিতে ফ্ল্যাট পান। রাইসিনা হিল্সে, রাষ্ট্রপতি ভবনের দক্ষিণে সাউথ অ্যাভেনিউ, উত্তরে নর্থ অ্যাভেনিউ। দু’দিকেই সাংসদদের ফ্ল্যাট। পল্টু ফ্ল্যাট পেয়েছে দিল্লির সাউথ অ্যাভেনিউয়ে। ফ্ল্যাটের বারান্দায় বসলে সামনে রাইসিনা হিল্স জুড়ে রাষ্ট্রপতি ভবন চত্বরের লাল দেওয়াল। চত্বরের দক্ষিণ দিকে ঘোড়ার আস্তাবল। যে সে ঘোড়া নয়, রাষ্ট্রপতির ঘোড়া। তাদের দলাই মলাই হয়, দৌড় করানো হয়। বারান্দায় বসে তার অনেকটাই দেখা যায়। এই ঘোড়ারাই রাষ্ট্রপতি ভবনের ‘সেরিমোনিয়াল’ কুচকাওয়াজে অংশ নেয়। আবার সংসদের যৌথ অধিবেশনকে সম্ভাষণ করতে রাষ্ট্রপতি যখন সংসদ ভবনে আসেন, তখন তাঁর আগে পিছে থাকে এই ছ’ফুটি ঘোড়া এবং তার উপরে গড়পড়তা সাড়ে ছ’ফুটি ঘোড়সওয়ার। হাতে তাঁদের বর্শা।
সেই ঘোড়াগুলিকে দু’বেলাই দেখতেন দিল্লিতে সদ্য ডেরা বাঁধা সাংসদ। এক দিন সাউথ অ্যাভেনিউয়ের ফ্ল্যাটের বারান্দায় দিল্লি বেড়াতে আসা দিদি, অন্নপূর্ণার সঙ্গে বসেছিলেন পল্টু। গল্প করতে করতে দিদিকে বলেই ফেলেন, “বুঝলে দিদি, পরের জন্মে রাষ্ট্রপতির ঘোড়া হয়েই জন্মাবো। কী নাদুসনুদুস চেহারা দেখেছ, কী যত্ন-আত্যি।” দিদি বলেন, “বালাই ষাট! পল্টু ঘোড়া হবি কেন? রাষ্ট্রপতিই হবি। আর সেটা এ জন্মেই।” ভাইয়ের উত্তর ছিল, “কী যে বল?”
সেই ভবিষ্যৎ বাণী যে এ ভাবে ফলে যাবে তা ভেবেই তো দিদির
চোখে জল।
২০০৭ সালেই এমন একটা সম্ভাবনা দেখা দিয়েছিল। সেই কথা মনে করে ‘দিদির ছেলে’, প্রণববাবুর বড় ভাগ্নে, বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক, তরুণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের বক্তব্য, “মায়ের কাছে তখনই আমরা এই গল্প শুনি। গল্পই আজ সত্যি হতে চলেছে।”
প্রণববাবুর জীবনে এমন ঘটনা বহু বারই ঘটেছে। তাঁর প্রয়াতা মা রাজলক্ষ্মী দেবী এক সময় এমনই এক গল্প শুনিয়েছিলেন। প্রণববাবুর বাবা, কামদাকিঙ্কর মুখোপাধ্যায় ছিলেন স্বাধীনতা সংগ্রামী। পরবর্তী ক্ষেত্রে এমএলসি-ও হন। বীরভূমের একজন বিশিষ্ঠ মানুষ। আশপাশের এলাকায় কোনও বড় অনুষ্ঠান, সভায় কামদাবাবু ছিলেন অবশ্য-আমন্ত্রিত। তেমনই এক অনুষ্ঠান, মিরিটি সংলগ্ন গঞ্জ গ্রাম, কীর্ণাহার হাইস্কুলে কোনও অনুষ্ঠানে কোনও এক মন্ত্রী গিয়েছেন। কামদাবাবুও সেখানে আমন্ত্রিত। অনুষ্ঠানে যাওয়ার আগে ‘অন্নর মাকে’ বলে গেলেন, “দেখ, ষষ্ঠী-পল্টু যেন আবার কীর্ণাহারে না চলে যায়।” ষষ্ঠী হলেন প্রণববাবুর মেজদা, পীযুষ মুখোপাধ্যায়। রাজলক্ষ্মী দেবী সংসারের কাজে ব্যস্ত। ছেলেদের উপর সারাক্ষণ নজরদারি তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। কতই বা বয়স হবে পল্টু-ষষ্ঠীর। বড় জোর দশ-বারো বছর, কী একটু বেশি। ইজের পরে দু’ভাই খেলা করছিল। বাবাকে যেতে দেখেই মেজদাকে বলে ভাই, “এ দাদা, কিরনারে মন্ত্রী এসছে। চ’ মন্ত্রী দেখে আসি।” ষষ্ঠীর একটু কিন্তু কিন্তু ছিল। কিন্তু ভাইয়ের চাপে দু’জনেই ওই খালি গায়ে, ইজের পরে হাজির প্রায় চার কিলোমিটার দূরের কীর্ণাহার স্কুলে। ভিড়ের মধ্যে মন্ত্রী দেখার জন্য উঁকি-ঝুঁকি মারতেই মঞ্চে বসা কামদাবাবুর সঙ্গে চোখাচোখি। ফিরতি দৌড়ে বাবা ফেরার আগেই মিরিটির বাড়িতে। বাবা ফিরে সে কী বকুনি।
এই গল্প শুনিয়ে রাজলক্ষ্মী দেবী বলেছিলেন, “দেখ, সেই পল্টুই এখন মন্ত্রী।” আজকের দিনে মায়ের কথা ভেবে মন খারাপ অন্নপূর্ণার। মা যদি দেখে যেতে পারতেন, সেই পল্টু আর শুধু মন্ত্রী নন, দেশের রাষ্ট্রপতি হতে চলেছেন! |
|
|
|
|
|