|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
বিদগ্ধ মননে উদ্ভাসিত প্রতিটি আলোকচিত্র |
সম্প্রতি সিগাল গ্যালারিতে অনুষ্ঠিত হল টি এস সত্যন-এর একক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ। |
তসবির এবং সিগাল আর্ট অ্যান্ড মিডিয়া রিসোর্স সেন্টার-এর যৌথ উদ্যোগে সিগাল-এর নিজস্ব গ্যালারিতে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল প্রখ্যাত আলোকচিত্রী টি এস সত্যন (১৯২৩-২০০৯)-এর আলোকচিত্রের প্রদর্শনী। প্রদর্শনীর শিরোনাম ‘রেকর্ডার অব লাইফ, বিউটি অ্যান্ড ট্রুথ’। ১৯৬৫ থেকে ২০০৭-এর মধ্যে তোলা ৩০টি সাদা-কালো ছবিতে শিল্পী প্রধানত ভারতবর্ষের বিভিন্ন অঞ্চলের সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন জীবনের নিহিত সত্যকে তুলে ধরতে চেয়েছেন। স্বাভাবিকতার সেই সত্যকে অসামান্য শৈল্পিক ঋদ্ধতায় তিনি নান্দনিক সৌন্দর্যে উদ্ভাসিত করেছেন। ভারত ছাড়া আফগানিস্তানে তোলা কয়েকটি ছবিও এই সংগ্রহে রয়েছে। সাদা-কালো বা আলো-ছায়ার অসামান্য বিন্যাস, দ্বিমাত্রিক পরিসরে ত্রিমাত্রিক জ্যামিতিক গাঠনিকতার বিদগ্ধ অনুভব দৃশ্যগত সত্যের বাইরেও নান্দনিক সৌন্দর্যের বিশেষ মাত্রা সৃষ্টি করেছে। এ সব কারণেই প্রদর্শনীটি বিশেষ ভাবে স্পর্শ করে।
টি এস সত্যন-এর জন্ম মাইসোরে। সেখানেই তাঁর পড়াশোনা। আলোকচিত্রে তাঁর কোনও প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ছিল না। ছাত্রজীবন থেকেই ক্যামেরায় ছবি তোলা ছিল তাঁর অত্যন্ত প্রিয় শখ। ছাত্রজীবনের শেষে সাংবাদিক আলোকচিত্রকেই পেশা হিসেবে গ্রহণ করেন। দেশে বিদেশে বহু নামী সংবাদপত্র ও পত্রিকার জন্য ছবি তুলেছেন। ১৯৭৭-এ তিনি ‘পদ্মশ্রী’ উপাধিতে ভূষিত হন। নিজের ছবির বিষয় সম্পর্কে তিনি বলেছেন, তিনি মূলত মানুষেরই ছবি তোলেন। সেই মানুষেরা ধনী বা বিখ্যাত নয়। তাঁরা সরল ও সাধারণ। তাঁরা সংবাদ শিরোনামে আসেন না। তবু তাঁরাই তাঁকে উদ্বুদ্ধ করে থাকেন। সাধারণ জীবনের ভিতর লুকিয়ে থাকা সৌন্দর্য, আনন্দ, দুঃখ ও করুণা এগুলিকেই শিল্পী উদ্ভাসিত করেছেন শৈল্পিক নৈপুণ্যে ও ঋদ্ধতায়।
|
|
শিল্পী: টি এস সত্যন |
১৯৪০-এর দশকে প্রতিষ্ঠাপ্রাপ্ত শিল্পীরা জীবনের বাস্তবকে নানা ভাবে অনুধাবন ও বিশ্লেষণের চেষ্টা করেছেন। চিত্রকলাতে আমরা তা বিশেষ ভাবে দেখেছি। পূর্ববর্তী নব্য-ভারতীয় ঘরানার আদর্শায়িত উপস্থাপনার প্রতিক্রিয়াতেই হয়তো এসেছিল সেটা। আলোকচিত্রেও এর প্রতিফলন দেখা যায়। সুনীল জানা বা শম্ভু সাহার আলোকচিত্র এ দিক থেকে বিশেষ উল্লেখযোগ্য। সত্যন এই ঘরানারই এক জন শিল্পী।
তাঁর তোলা ছবিতে অনুপুঙ্খ স্বাভাবিকতার ভিতর দু’টি চিত্রীয় আঙ্গিক-প্রকল্পের পরোক্ষ প্রতিফলন অনুভব করা যায়। একটি ইম্প্রেশনিজম বা প্রতিচ্ছায়াবাদ। অন্যটি জ্যামিতিক গাঠনিকতা। কিন্তু রূপের কোনও বিকৃতিকরণ বা ডিস্টর্সন তিনি করেননি। যে সময়ে তিনি ছবি তুলেছেন তখন পাশ্চাত্য আলোকচিত্রে এক্সপ্রেশনিজম, কিউবিজম ও সুররিয়ালিজমের আঙ্গিক নিয়ে নানা রকম পরীক্ষা-নিরীক্ষা হয়েছে। সত্যম সে সব ভাঙনের পথে না গিয়ে চেয়েছেন জীবনের সহজ সত্যকে সাবলীল ভাবে রূপ দিতে।
যে ছবির অংশবিশেষ এই লেখার সঙ্গে আমরা দেখছি সেটি ১৯৮০তে কারোয়ারে তোলা নদীতে জেলের জাল ফেলার দৃশ্য। নদীবক্ষে নৌকার উপর দাঁড়িয়ে জেলে জাল ছুড়েছে। জালটি শূন্যে ছড়িয়ে আছে। বিষয়ের কারণেই এখানে আলো-ছায়ার যে বিন্যাস নৌকাটির আঁধারে মিশে থাকা, নৌকার উপর জেলের সিল্যুট, নদীর জলে ছোট ছোট তরঙ্গে সাদা আর কালোর নিমগ্ন কথোপকথন, এ সমস্তের প্রাকৃতিক স্বাভাবিকতাকে ছাড়িয়ে বেশি করে প্রতিভাত হয় শিল্পীর মনন ও কল্পনা। সে দিক থেকে এর আঙ্গিকে অনুভব করা যায় প্রতিচ্ছায়াবাদী রীতির অনুষঙ্গ। ১৯৭৬-এর অমৃতসরে তোলা স্বর্ণমন্দিরের ছবিটিতে জলের উপর আলোছায়ার কম্পনকেও একই আঙ্গিকের অন্তর্গত ভাবা যায়। কর্নাটকে (১৯৭২) শ্রিনগেরিতে দুই পুরোহিত হেঁটে যাচ্ছে। মাথায় তাঁদের বৃহদাকার তালপাতার ছাতা। প্রেক্ষাপটে দিগন্ত পর্যন্ত শূন্যতা পরিব্যাপ্ত। প্রতিচ্ছায়াবাদ ও স্বাভাবিকতার অসামান্য সমন্বয় এখানে। আবার শ্রাবণবেলগোলায় বুদ্ধের বিপুল পদপল্লব স্পর্শ করছে এক গ্রামীণ মানবী (১৯৭৬), এই ছবিতে স্বাভাবিকতার মধ্যেও একটু অভিব্যক্তিবাদী অনুষঙ্গ কি নেই, যদিও তেমন ভাবে ভাঙা হয়নি রূপ? স্থাপত্যের একটি অসামান্য ছবি ১৯৭৬-এ কর্নাটকের বিদার-এর একটি মন্দিরের অভ্যন্তর। স্তম্ভগুলির জ্যামিতিক গাঠনিকতা, অভ্যন্তরে গর্ভগৃহের অন্ধকারের আয়তনময়তা সমস্তই গভীর এক আধ্যাত্মিক বোধে স্পন্দিত হতে থাকে। আফগানিস্তানে ১৯৬৫তে তোলা একটি ছবিতে দেখা যায় অ্যালুমিনিয়ামের বাসনপত্র বিক্রির একটি দোকান। ছাদ থেকে ঝুলছে অজস্র কেটলি, মেঝেতে সাজানো থালা, বাটি, হাঁড়ি, কলসি। পাগড়ি মাথায় দোকানি বসে আছে তার মধ্যে। একটি জীবন্ত ইনস্টলেশন যেন। এ রকমই বিদগ্ধ মননে উদ্ভাসিত প্রতিটি আলোকচিত্র। |
|
|
|
|
|