লক্ষ্য ছিল উন্নয়নের কাজে গতি, দক্ষতা ও স্বচ্ছতা আনা। তাই হাতে-হাতে দরপত্র (টেন্ডার) পেশের সাবেক পদ্ধতি তুলে দিয়ে সেখানে অনলাইন ব্যবস্থা চালু করেছে পশ্চিমবঙ্গ সরকার। কিন্তু গত ১ জানুয়ারি সেই ‘ই-টেন্ডারিং’ বলবৎ হওয়ার পরে স্বচ্ছতা-দক্ষতা কতটা বেড়েছে, তা নিয়ে সমীক্ষা না-হলেও পূর্ত ও সেচ দফতরের কাজের গতি যে শ্লথ হয়ে গিয়েছে, তা ইতিমধ্যে স্পষ্ট। বস্তুত টেন্ডার-বিপত্তিতেই আটকে গিয়েছে রাস্তা তৈরি ও বাঁধ মেরামতির মতো বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প, যার কয়েকটি বর্ষার আগে শেষ করার কথা ছিল।
নতুন ব্যবস্থায় উল্টো ফল কেন?
এ জন্য আঙুল উঠেছে মূলত একশ্রেণির ঠিকাদারের ‘অসহযোগিতা’র দিকে। এঁরা নিজেদের মধ্যে যোগসাজস করে গোটা প্রক্রিয়াটিকে ভন্ডুল করে দিতে চাইছেন বলে মহাকরণ-সূত্রের অভিযোগ। সূত্রটির দাবি, “আগে নথিভুক্ত ঠিকাদারেরা টেন্ডারের ক্ষেত্রে কিছু সুবিধা পেতেন, যেগুলোর সংস্থান নতুন পদ্ধতিতে রাখা হয়নি। তাই ঠিকাদারদের একটি মহল ‘ষড়যন্ত্রমূলক আঁতাতের’ মাধ্যমে চেষ্টা চালাচ্ছেন, সরকার যাতে দরপত্র দাখিলের পুরনো পদ্ধতিতে ফিরতে বাধ্য হয়।” কী ভাবে?
মহাকরণের খবর: নতুন নিয়মে পাঁচ লক্ষ টাকার বেশি কাজ হলে ই-টেন্ডার করতে হবে। ফলে বহু প্রকল্পে অনলাইনে দরপত্র চাইতে হচ্ছে। অথচ অনেক ক্ষেত্রে একাধিক বার টেন্ডার করেও একটার বেশি আবেদন মেলেনি, যেখানে বিধি মোতাবেক অন্তত তিনটে টেন্ডার জমা পড়তেই হবে। ফলে আগেরটা বাতিল করে ফের টেন্ডার ডাকতে হচ্ছে। এবং প্রায় প্রতিটি ক্ষেত্রে একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি দেখছেন অফিসারেরা।
ঠিকাদারদের অভিযুক্ত মহল এই বিচিত্র ‘সমাপতনের’ দায় অস্বীকার করছেন। তবে ঘটনা হল, ই-টেন্ডার ব্যবস্থা এ ভাবে ভেস্তে যাওয়ায় নির্ধারিত বহু প্রকল্পে হাতই দেওয়া যাচ্ছে না। সবচেয়ে বিপাকে পড়েছে পূর্ত দফতর। কেন্দ্রীয় অনগ্রসর অঞ্চল অনুদান তহবিল (বিআরজিএফ)-এর ১৪৭০ কোটি টাকা নিয়ে তারা বসে আছে। তা দিয়ে রাজ্যের ১১ জেলায় ১৪৫টি প্রকল্প শুরু করার কথা। কিন্তু টেন্ডার প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ না-হওয়ায় বেশ কিছু প্রকল্প নিয়ে এখন ঘোর সংশয়। এমনকী পূর্ত-কর্তাদের একাংশের আশঙ্কা, কাজ না-হওয়ায় কেন্দ্র টাকা ফেরত চাইতে পারে। অবস্থাটা ঠিক কী রকম?
রাজ্যের পূর্ত-সচিব অজিতরঞ্জন বর্ধন বলেন, “প্রায় কুড়ি-পঁচিশটি প্রকল্পে প্রথম দফার ই-টেন্ডারে আবশ্যিক তিনটির কম আবেদন জমা পড়ায় আবার টেন্ডার ডাকতে হয়েছে।” দ্বিতীয় দফাতেও যদি একই ব্যাপার হয়?
পূর্ত-সূত্রের খবর: ওই সম্ভাবনা মাথায় রেখে বিকল্প সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, যাতে কাজ থমকে না-থাকে। স্থির হয়েছে, এ বার যদি শুধু একটা বৈধ দরপত্রও জমা পড়ে, তা হলে বরাত সেই সংস্থাকেই দিয়ে দেওয়া হবে। এ জন্য অর্থ দফতরের অনুমতি নেওয়া হয়েছে। কম সংখ্যায় দরপত্র দাখিলের পিছনে ‘আঁতাতের’ ছায়া দেখছেন পূর্ত-কর্তাদের অনেকেই। যাঁদের দাবি, “চক্রের উদ্দেশ্য ব্যর্থ করে কাজ এগিয়ে নিয়ে যেতে হলে এমন সিদ্ধান্ত না-নিয়ে উপায় নেই।”
কিন্তু এক জন মাত্র আবেদনকারীর টেন্ডার গ্রহণ করে তাঁকে কাজ দিলে ই-টেন্ডারিংয়ের আসল উদ্দেশ্যটাই কি ব্যাহত হবে না?
সরকারি মহলে এ প্রশ্নও উঠছে। কিছু আধিকারিকের আশঙ্কা, এতে প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা তো থাকবেই না, উপরন্তু পরে এটাই প্রথা হয়ে দাঁড়াতে পারে। সেচমন্ত্রী মানস ভুঁইয়া জানিয়ে দিয়েছেন, তাঁরা পূর্তের পথে হাঁটবেন না। ই-টেন্ডারের ‘অকৃতকার্যতা’য় সেচেরও বিস্তর কাজ আটকে আছে। সমাধান-সূত্র হিসেবে সেচমন্ত্রী বলছেন, “দ্বিতীয় বারেও অন্তত তিনটে টেন্ডার জমা না-পড়লে সরকারি সংস্থাকে বরাত দেওয়া হবে। সে জন্য অর্থ দফতরের অনুমতি নেওয়া হবে। অনির্দিষ্ট কাল কাজ ফেলে রাখা হবে না।”
পূর্ত-সূত্রের খবর: সারা রাজ্যে তাদের ‘নথিভুক্ত’ সরকারি ঠিকাদারের সংখ্যা শ’খানেক। বাম আমলে সাড়ে ৬২ লক্ষ টাকা পর্যন্ত কাজের বরাতে তাঁদের অগ্রাধিকার দেওয়া হত। ই-টেন্ডারিংয়ে সে সুবিধে নেই। পাশাপাশি রাস্তা-বাড়ি নির্মাণ ও তার বার্ষিক রক্ষণাবেক্ষণে ‘গ্রুপ টেন্ডার’ও তুলে দেওয়া হয়েছে। নতুন ব্যবস্থায় ঠিকাদারদের একাংশের যে আপত্তি রয়েছে, পূর্তমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষদস্তিদারকে লেখা ‘জলপাইগুড়ি কন্ট্রাক্টর্স অ্যাসোসিয়েশন’-এর এক চিঠিতে তার ইঙ্গিত স্পষ্ট। ই-টেন্ডারিংয়ে ‘রেজিস্টার্ড’ ঠিকাদারদের জন্য বিশেষ সুযোগ না-থাকায় ‘অসুবিধের’ কথা উল্লেখ করে চিঠিতে মন্ত্রীকে আর্জি জানানো হয়েছে, নতুন ব্যবস্থা থেকে তাঁদের যেন অন্তত পাঁচ বছর ছাড় দেওয়া হয়।
পূর্ত-সচিব অবশ্য ‘অসুবিধে’র কারণ বুঝতে পারছেন না। তাঁর বক্তব্য, “ই-টেন্ডারিংয়ে স্বজনপোষণ, পক্ষপাতিত্বের জায়গা নেই। তাড়া তাড়া কাগজপত্র নিয়ে ইঞ্জিনিয়ারের অফিসে ছোটাছুটিরও দরকার পড়ে না। টেন্ডার জমা দেওয়া অনেক সহজ।” তাঁর আরও দাবি, অনলাইনে টেন্ডার জমা দিতে ঠিকাদারের যাতে সমস্যা না-হয়, সে জন্য আগে থেকে জেলায়-জেলায় ন্যাশনাল ইনফর্মেটিক সেন্টারের কর্মীদের দিয়ে প্রশিক্ষণেরও ব্যবস্থা হয়েছিল। “তা সত্ত্বেও আপত্তি কেন, মাথায় ঢুকছে না।” মন্তব্য সচিবের।
এই পরিস্থিতিতে মহাকরণের বিভিন্ন মহলে এক শ্রেণির ঠিকাদারের বিরুদ্ধে ‘অন্তর্ঘাতের’ অভিযোগ উঠলেও ঠিকাদারেরা তা মানতে নারাজ। তাঁদের প্রতিনিধিরা বলছেন, “সরকারি কাজই আমাদের রুজি-রুটি। তা ভেস্তে দিয়ে নিজেদের পায়ে কুড়ুল মারব কেন?” ওঁদের দাবি, “সব ঠিকাদারকে নতুন ব্যবস্থায় সড়গড় করে তুলতে সময় দরকার। তাই আমরা চাইছি, প্রক্রিয়াটিকে কিছু দিন পিছিয়ে দেওয়া হোক।” |