নৌকাভর্তি যাত্রীদের মধ্যে থেকে এক গৃহবধূ ‘অপহৃত’ হওয়ার পরে শ্বশুরবাড়ি থেকে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। জয়শ্রী দাস (২১) নামে ওই মহিলার বাপের বাড়ির পক্ষ থেকে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকের বিরুদ্ধে অপহরণ করে খুনের অভিযোগ করা হয়েছে। ঘটনাটি ঘটেছে বুধবার সকালে সন্দেশখালির ভাঙাতুষখালি গ্রামে। বাপের বাড়ির তরফে দাবি করা হয়েছে, জয়শ্রী দেবীকে যে খুন করা হতে পারে সে ব্যাপারে পুলিশকে আগে থেকে জানানো হয়েছিল। পুলিশ ব্যবস্থা নিলে হয়তো জয়শ্রীদেবীকে বাঁচানো যেত। যদিও পুলিশের দাবি, খবর পেয়েই সঙ্গে সঙ্গে গ্রামে যাওয়া হয়। কিন্তু সেখানে গিয়ে জয়শ্রীদেবীর মৃতদেহ উদ্ধার হয়।
বসিরহাটের এসডিপিও আনন্দ সরকার বলেন, “ওই মহিলার উপরে স্বামী ও শ্বশুরবাড়ির লোকেরা নির্যাতন চালাচ্ছেন বলে আগেই থানায় অভিযোগ জানানো হয়েছিল। এর পর বসিরহাটে আদালতে ওই মহিলা বিবাহবিচ্ছেদের মামলা করেন। সেই মামলা চলছিল। গত ১৩ জুন ওই মহিলাকে নৌকা থেকে তুলে নিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়। পরে শ্বশুরবাড়িতে তাঁর মৃতদেহ উদ্ধার হয়। বাপের বাড়ির তরফে খুনের অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। দেহ ময়নাতদন্তে পাঠিয়ে ঘটনার তদন্ত শুরু হয়েছে। অভিযুক্তদের সকলকেই গ্রেফতার করা হবে।”
পুলিশ ও স্থানীয় সূত্রে জানা গিয়েছে, বছর ১২ আগে সন্দেশখালি থানার দুর্গামণ্ডব গ্রামের জয়শ্রীদেবীর সঙ্গে ভাঙাতুষখালির বাসিন্দা অজয় দাসের বিয়ে হয়। তাঁদের তিন সন্তানও রয়েছে। বিয়ের আগে অজয় মেছোভেড়িতে পাহারাদারের কাজ করে বললেও বিয়ের পরে জয়শ্রীদেবীর বাপের বাড়ির লোকেরা জানতে পারেন আসলে সে চুরি, ডাকাতি, ছিনতাই, নারী পাচারের কাজে জড়িত। বিভিন্ন থানায় তার বিরুদ্ধে একাধিক অভিযোগও রয়েছে। বিয়ের পর আরও পণের দাবি এবং মাঝেমধ্যেই কোনও মহিলাকে নিজের বাড়িতে এনে রাখাকে কেন্দ্র করে স্বামীর সঙ্গে অশান্তি শুরু হয় জয়শ্রীদেবীর। এ সব কথা কাউকে যাতে না বলা হয় সে জন্য জয়শ্রীদেবীর উপরে অজয় শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন চালাত বলে বাপের বাড়ির লোকের অভিযোগ। এ নিয়ে বাপের বাড়ির তরফে একাধিকবার সালিশি সভা বসানো হলেও অজয়ের আচরণের কোনও পরিবর্তন হয়নি। উল্টে দিনের পর দিন অত্যাচারের মাত্রা বাড়ছিল। ইতিমধ্যে স্বামী গুরুতর যৌন রোগে আক্রান্ত হয়েছে বলে জানতে পারেন জয়শ্রী। এমনকী সে জন্য চিকিৎসক যে তাঁর স্বামীকে কোনও শারীরিক সম্পর্ক না করার পরামর্শ দিয়েছেন তাও জানতে পারেন জয়শ্রীদেবী। কিন্তু চিকিৎসকের পরামর্শ অগ্রাহ্য করেই জোর করে স্ক্রী সঙ্গে শারীরিক সম্পর্ক করায় অসুস্থ হয়ে পড়েন জয়শ্রীদেবী। বিষয়টি তিনি বাপের বাড়িতেও জানান। কিন্তু ক্রমাগত অত্যাচার বাড়তে থাকায় শেষ পর্যন্ত নিরুপায় হয়ে মাস তিনেক আগে শ্বশুরবাড়ি ছেড়ে চলে আসেন জয়শ্রীদেবী। কলকাতায় একটি বাড়িতে ছেলেমেয়ে দেখাশোনার কাজ নেন এবং স্বামীর সঙ্গে আর থাকতে চান না বলে বিবাহ বিচ্ছেদের মামলা করেন।
জয়শ্রীদেবীর বোন অপর্ণাদেবী জানান, গত ১১ জুন তিনি দিদির সঙ্গে আদালতে যাচ্ছিলেন। সেই সময় রাস্তায় ধামাখালি বাসস্টপে অজয় ও তার সঙ্গীরা তাঁদের আটকে হুমকি দেয় ‘আদালতে গেলে ফল খারাপ হবে’। এমনকী খুনের হুমকিও দেওয়া হয়। পরদিন তাঁরা সন্দেশখালি থানায় এ ব্যাপারে অভিযোগ দায়ের করেন। আদালতকেও বিষয়টি জানানো হয়। কিন্তু এ সব জানতে পেরে যায় অজয়। গত ১৩ জুন আদালতে যাওয়ার দিন থাকায় দিদিকে নিয়ে রওনা হন অপর্ণাদেবী। তিনি বলেন, “দিদিকে নিয়ে আমি ওই দিন সকালে নৌকায় ধামাখালি আসছিলাম। সাতটা নাগাদ পথে মালিপাড়ার ঘাটে এক মহিলা যাত্রী নৌকা থামাতে বলেন। নৌকা ঘাটে ভিড়তে হঠাৎই গাছের আড়াল থেকে কয়েকজন বেরিয়ে এসে আমাকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়ে নৌকা থেকে দিদিকে জোর করে তুলে নিয়ে চলে যায়। তাদের মধ্যে জামাইবাবু, দিদির শাশুড়ি, ননদ ও তার স্বামী এবং দেওর ছিল। সঙ্গে সঙ্গে আমি সন্দেশখালি থানায় গিয়ে সব জানাই। থানা থেকে আমাকে মথুরা পুলিশ চৌকিতে যেতে বলা হয়। সেখানে গেলে পুলিশ জামাইবাবুকে ফোন করে। সেই সময় ফোনের ওপ্রান্ত থেকে এক মহিলা কণ্ঠ জানায়, ‘পুলিশ ক্যাম্প থেকে কাউকে গ্রামে আসতে হবে না। ওরা আমাকে ছেড়ে দিয়েছে। আমি এক ঘণ্টার মধ্যে চলে আসছি’।” কিন্তু নির্ধারিত সময়ের পরেও জয়শ্রীদেবী না ফেরায় বেলা ১১টা নাগাদ পুলিশ অপর্ণাদেবীকে নিয়ে ভাঙাতুষখালি গ্রামে যায়। সেখানে অজয়ের বাড়ি থেকে জয়শ্রীদেবীর নিথর দেহ উদ্ধার হয়। |