এক দিকে ভোটের নির্ঘণ্ট ঘোষণা। অন্য দিকে নাটকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের দিল্লিতে পদার্পণ। সব মিলিয়ে আজ থেকে ফের রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে উত্তেজনা তুঙ্গে।
মমতাকে আজ দিল্লি আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে গত রাতেই ১০ জনপথ থেকে তাঁর কাছে একাধিক বার ফোন যায়। তাঁকে দিল্লি আসার জন্য অনুরোধ করেন স্বয়ং সনিয়া গাঁধী। উভয় শিবিরের দাবি, গত কয়েক দিন ধরে মমতা ও কংগ্রেসের মধ্যে যোগাযোগের যে ত্রুটি হচ্ছিল, দূরভাষের সেই কথোপকথনে তার মীমাংসা অনেকটাই হয়ে যায়। তার পরই মোর্চার সঙ্গে বৈঠক দু’দিন পিছিয়ে দিয়ে আজ সন্ধ্যায় দিল্লি পৌঁছন ইউপিএ-র বৃহত্তম শরিক দলের নেত্রী।
তৃণমূল নেত্রীর ঘনিষ্ঠ সূত্রে বলা হচ্ছে, সনিয়াকে মমতা জানিয়েছেন, আলোচনার মাধ্যমে সর্বসম্মতিতে পৌঁছনোটাই স্বাভাবিক। অথচ গত কয়েক দিন ধরেই তিনি শুনছেন, এমনকী কংগ্রেসের অনেকেও বলাবলি করছেন, প্রার্থী স্থির করে ফেলেছে কংগ্রেস। তা যদি হয়, তা হলে আর আলোচনার অর্থ কী! কিন্তু সনিয়া তাঁকে জানান, এ সব ভ্রান্ত প্রচার। আপনি আগে দিল্লি আসুন। তার পর আলোচনা হবে। |
কংগ্রেস যে এখনও রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী চূড়ান্ত করেনি, সেই বার্তা দিতে গত শনিবারই দলের ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য জনার্দন দ্বিবেদী বিবৃতি দেন। আজ তার পুনরাবৃত্তি করে দলের মুখপাত্র মণীশ তিওয়ারি বলেন, “ইউপিএ-তে যে সুষ্ঠু সমন্বয় ও ঐক্য রয়েছে, সনিয়া-মমতা সম্ভাব্য বৈঠককে কেন্দ্র করে সেটাই প্রতিফলিত হচ্ছে।” তবে মূল প্রশ্ন হল, কাল মমতার সঙ্গে বৈঠকে সনিয়া কি শেষ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের নাম প্রার্থী হিসেবে প্রস্তাব করবেন? নাকি মমতার বিবেচনার জন্য একসঙ্গে দু-তিন জনের নাম বলবেন? সে দিক থেকে রাষ্ট্রপতি প্রার্থী হয়ে ওঠার জন্য আগামিকাল প্রণববাবুরও লিটমাস পরীক্ষা।
কংগ্রেস সূত্রে বলা হচ্ছে, গত কাল মমতাকে প্রথম ফোনটি করেন সনিয়ার রাজনৈতিক সচিব আহমেদ পটেল। কংগ্রেস নেতৃত্ব মমতার সঙ্গে বৈঠকে কতটা উদগ্রীব, তা বোঝাতে তিনি দিল্লি আসার জন্য পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রীকে ব্যক্তিগত বিমানের ব্যবস্থা করে দেওয়ারও প্রস্তাব দেন। যদিও মমতা তা নিতে চাননি। তবে জানান, সোমবারই তিনি দিল্লি যাওয়ার প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলেন। এ ব্যাপারে আহমেদ পটেলকে এসএমএস-ও পাঠান। কিন্তু কোনও জবাব পাননি। আহমেদ তখন জানান, তিনি ফোন বদলেছেন বলেই হয়তো এই সমস্যা হয়েছে।
তবে তৃণমূল সূত্রে বলা হচ্ছে, সোমবার সম্ভবত কংগ্রেস বৈঠকের জন্য প্রস্তুত ছিল না। ওই দিন প্রণববাবুর সঙ্গে অমিত মিত্রের বৈঠক হয়। তার পরেই মমতার সঙ্গে বৈঠকের প্রস্তুতি শুরু করেন সনিয়া। কংগ্রেসের কাছে এটা স্পষ্ট, মমতাকে বাদ দিয়ে নীতীশ বা বামেদের সমর্থনে নিজেদের প্রার্থীকে জিতিয়ে আনা হয়তো সম্ভব হবে, কিন্তু তাতে দীর্ণ ইউপিএ-র ছবিই ফুটে উঠবে। তার চেয়ে মমতাকে পাশে নিয়ে প্রার্থীর নাম চূড়ান্ত করলে ইতিবাচক বার্তা দেওয়া সম্ভব হবে।
মমতাকে পাশে পেতে কংগ্রেস যখন এতটা সক্রিয়, তখন আজ তাৎপযপূর্ণ ভাবেই দিল্লি বিমানবন্দর থেকে তিনি সোজা রওনা দেন সপা নেতা মুলায়ম সিংহের বাসভবনের দিকে। সঙ্গে ছিলেন সমাজবাদী পার্টির সাধারণ সম্পাদক কিরণময় নন্দ। রাষ্ট্রপতি পদে কংগ্রেস প্রার্থীকে সপা সমর্থন জানানোর ইঙ্গিত দেওয়ার পাশাপাশি মুলায়ম এ-ও জানান, প্রণববাবুকে প্রার্থী করা হচ্ছে, এমন কথা কংগ্রেস তাঁকে জানায়নি। এই অবস্থায় তাঁর সঙ্গে সমন্বয় রেখেই এগোতে চাইছেন মমতা। |
স্বাভাবিক ভাবেই এতে নর্থব্লকে উৎকণ্ঠা বেড়েছে। কাল এক দিনের আফগানিস্তান সফর বাতিল করেছেন প্রণববাবু। তৃণমূল সূত্রে বলা হচ্ছে, প্রণববাবুকে সমর্থন জানাতে মমতা এখনও নরম নন। তৃণমূলের যুক্তি, এত বড় মন্ত্রী হয়েও প্রণববাবু যদি রাজ্যের জন্য ‘মোরাটোরিয়ামের’ ব্যবস্থা না করেন, তবে তাঁকে সমর্থন জানানোর পরে মানুষের কাছে কী জবাব দেবে তৃণমূল? অবশ্য এ-ও প্রশ্ন উঠেছে, মমতা কি তা হলে ‘ব্ল্যাকমেলের’ রাজনীতি করছেন? মমতা ঘনিষ্ঠদের বক্তব্য, রাজ্যের জন্য ‘মোরাটোরিয়াম’ এক বছর ধরে চাইছেন মমতা। কেন্দ্র যদি তা না দেয় এবং রাষ্ট্রপতি ভোটের ঠিক আগে বৈঠক ডাকে, তবে দায়িত্ব কার? বরং কংগ্রেসই দু’টি বিষয়কে এক বন্ধনীতে এনে দেখছে। মমতা আজ কলকাতা ছাড়ার আগে বলেছেন, “দু’টোকে গুলিয়ে ফেলবেন না। ওটা (আর্থিক বিষয়টি) একটি ধারাবাহিক বিষয়। (সনিয়ার সঙ্গে) আমার কথা হবে শুধু রাষ্ট্রপতি নির্বাচন নিয়ে।” কলকাতায় সরকারের এক মুখপাত্র যদিও জানান, রাজ্যের আর্থিক হাল সংক্রান্ত সব নথিপত্র নিয়েই দিল্লি গিয়েছেন মমতা।
মুলায়মের সঙ্গে বৈঠকের শেষে তাস কিন্তু সযত্নে আস্তিনে রেখে দিলেন মমতা। মুখে হাসি, পাশে সপা প্রধান। বৈঠক শেষে বেরিয়ে শুধু বললেন, “কাল সনিয়াজির সঙ্গে বৈঠক। তার পর ফের মুলায়মজির সঙ্গে দেখা করতে আসব।” তৃণমূল সূত্রের খবর, মুলায়মের সঙ্গে আজ সম্ভাব্য প্রার্থী নিয়ে এক দফা কথা হয়েছে মমতার। মুলায়মের বক্তব্য, এক জন রাজনীতিক রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থী হলেই ভাল। এই অবস্থায় তৃণমূলের এক সূত্র বলছে, প্রণববাবুকে উপ-রাষ্ট্রপতি করার প্রস্তাবও দিতে পারেন মমতা। অথবা প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ কৃষ্ণা বসুর নামও প্রস্তাব করতে পারেন ওই পদে। |