চার দিন ধরে পেটের যন্ত্রণায় ভুগছিল এক মাসের শিশুটি। কিন্তু, হাসপাতালে প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো না থাকায় সিউড়ি সদর হাসপাতালের চিকিৎসকেরা ধরতে পারছিলেন না অতটুকু বাচ্চার যন্ত্রণার কারণ। তাকে ‘রেফার’ করা হয় বর্ধমান মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে গিয়ে চিকিৎসা পেয়ে পর দিব্যি সুস্থ হয়ে উঠেছে ওই শিশু।
এই পর্যন্ত গল্পটা খুব সহজ। আবার সহজ নয়-ও। নয়, কারণ শিশুটির এই কয়েক দিনের লড়াইয়ের সঙ্গী আরও কয়েক জন। তাঁদের জন্যই এক মাসের ওই ফুটফুটে শিশুকে সুস্থ অবস্থায় ফিরে পেলেন দুবরাজপুরের কোটা গ্রামের দিনমজুর রাজীব রুইদাস ও স্ত্রী কালোমতিদেবী। তাঁদের মধ্যে যেমন রয়েছেন বীরভূমের অতিরিক্ত জেলাশাসক (সাধারণ) অমিতাভ সেনগুপ্ত, তেমনই আছেন সিউড়ি শহরের এক স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্তা রমণীমোহন ভট্টাচার্য। আছেন সিউড়ি হাসপাতালেরই শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা বাচ্চাদের মায়েরা।
৬ জুন সদর হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার তিন দিনের মাথায় শনিবার রাতে শল্য চিকিৎসক সমর দাস রুইদাস দম্পতিকে তাঁদের শিশুপুত্রকে বর্ধমানে নিয়ে যেতে বলেন। কিন্তু দুঃস্থ ওই দম্পতির পক্ষে শিশুটিকে গাড়ি ভাড়া করে বর্ধমানে নিয়ে যাওয়া কিংবা চিকিৎসা করানোর আর্থিক সঙ্গতি ছিল না। তাঁরা পড়েন অকূল পাথারে। হাসপাতালের সঙ্গে যোগাযোগ করে জানতে পারেন, ‘নিশ্চয় যান’ প্রকল্পে অসুস্থ শিশুদের নিয়ে যাওয়ার জন্য হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই গাড়ির ব্যবস্থা করে। কিন্তু তা শুধুমাত্র ১-২৮ দিনের শিশুদের জন্যই প্রযোজ্য। বয়স এক মাস হওয়ায়, সেই সুবিধাও পাননি তাঁরা।
রাজীববাবুর কথায়, “মাথা কাজ করছিল না। ভাবছিলাম বাচ্চাটাকে বোধহয় আর বাঁচাতে পারব না।” কিন্তু তত ক্ষণে হাসপাতালের এক কর্মীর কাছ থেকে খবর পেয়ে হাজির হন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার কর্ণধার রমণীমোহনবাবু। তিনি যোগাযোগ করেন অতিরিক্ত জেলাশাসকের সঙ্গে। অমিতাভবাবু সব শুনে বলেন, “যত দ্রুত সম্ভব গাড়ি করে শিশুটিকে বর্ধমানে পাঠানোর ব্যবস্থা করুন। গাড়ি ভাড়া যা লাগে আমি দেব।” কিছুক্ষণের মধ্যেই ব্যবস্থা হয় গাড়ির।
গাড়ি তো হল। চিকিৎসা আর ওষুধের খরচ জোগাবে কে? এ বার এগিয়ে এলেন শিশু ওয়ার্ডে ভর্তি থাকা কয়েকটি বাচ্চার মা। অনিতা মুখোপাধ্যায়, ডালিয়া বিবি, রবিতা মাহারা, ফরিদা বিবিরা ওয়ার্ডের মধ্যেই চাঁদা তুললেন। মিনিট পনেরোর মধ্যেই উঠল ৭২০ টাকা। তাঁরা তা তুলে দেন রাজীববাবুদের হাতে। বর্ধমানে নিয়ে যাওয়ার জন্য শিশুটিকে গাড়িতে চাপানোর সময় ওই মহিলাদের চোখে জল। শিশুর মাকে তাঁদের প্রবোধ, “ঈশ্বর, আল্লা তোমার ছেলেকে তাড়াতাড়ি সুস্থ করে দেবেন।”
প্রশ্ন উঠেছে, শিশুর কী হয়েছিল তা চার দিনেও (৬-৯ জুন) নির্ণয় করা গেল না? শল্যচিকিৎসক সমর দাস-এর যুক্তি, “শনিবারই প্রথম ওই শিশুকে আমার কাছে আনা হয়। ওর পেটে যে ব্যাথা হচ্ছিল, তা পরীক্ষা করার পরিকাঠামো আমাদের হাসপাতালে নেই। তাই বাধ্য হয়েই শিশুটিকে রেফার করি।” সদর হাসপাতালের সুপার মানবেন্দ্র ঘোষ অবশ্য বলেন, “এমন হওয়ার কথা নয়। ওই শিশুর অভিভাবক লিখিত অভিযোগ করলে খতিয়ে দেখব।” সেই শিশু বর্ধমান মেডিক্যালের চিকিৎসায় রবিবার সকাল থেকে অনেকটাই সুস্থ। এই খবরে দারুন খুশি অনিতা, ডালিয়া, ফরিদারা। বলেছেন, “বাচ্চাটাকে অমন যন্ত্রণা পেতে দেখে কি চুপ থাকা যায়! ওর বাবা-মায়ের আর্থিক অবস্থা জেনে তাই এগিয়ে না এসে পারিনি।” রমণীবাবুর কথায়, “মানুষের প্রয়োজনে মানুষ পাশে দাঁড়াবে এটাই তো স্বাভাবিক।” আর অতিরিক্ত জেলাশাসক বলছেন, “সব জেনে আমার মনে হয়েছিল ওই দুঃস্থ পরিবারের এক মাসের শিশুটির সাহায্যে অবশ্যই এগিয়ে আসা উচিত।” আর কৃতজ্ঞ রাজীববাবু বর্ধমান থেকে ফোনে বলেন, “ওঁদের কথা জীবনে ভুলব না।” |