দলীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে বিদ্রোহ ঘোষণা করার অপরাধে সিপিএম থেকে বহিষ্কার করা হল প্রাক্তন সাংসদ অনিল বসুকে। আরামবাগের এই দাপুটে নেতার বিরুদ্ধে ‘চূড়ান্ত শাস্তিমূলক ব্যবস্থা’ অর্থাৎ বহিষ্কারেরই সুপারিশ করেছিল রাজ্য কমিটি। আলিমুদ্দিনের সেই সুপারিশেই ‘সিলমোহর’ বসিয়েছেন দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্ব। দিল্লিতে রবিবার কেন্দ্রীয় কমিটির বৈঠকের দ্বিতীয় দিনে এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সাসপেন্ড থাকাকালীনই দলের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে তোপ দাগতে গিয়ে অনিলবাবুর যা পরিণতি হল, তেমন নজির সাম্প্রতিক কালে সিপিএমে নেই।
সিপিএম সূত্রের বক্তব্য, রাজ্যে ‘ঘুরে দাঁড়াতে’ বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য-বিমান বসুরা দলে ‘শুদ্ধকরণে’র চেষ্টা চালাচ্ছেন এবং ‘অ-কমিউনিস্ট সুলভ আচরণ’ প্রশ্রয় দেওয়া হবে না বলে ‘কড়া বার্তা’ দিতে চাইছেন। সেই পথে হেঁটেই অনিলবাবুর বিরুদ্ধে কড়া মনোভাব নিয়েছে দল। ‘দুর্নীতিতে প্রশ্রয়’ ও ‘স্বজনপোষণে’র অভিযোগে গত ২৯ এপ্রিল অনিলবাবুকে তিন মাসের জন্য সাসপেন্ড করেছিল রাজ্য কমিটি। সিপিএমের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী, কাউকে সাসপেন্ড করা হলে তা প্রকাশ্যে ঘোষণা করা হয় না। সাসপেন্ড থাকাকালীন তাঁর আচরণবিধির উপরে নজর রাখা হয়। কিন্তু সাসপেনশনের সিদ্ধান্তের পরেই অনিলবাবু রাজ্য সম্পাদক বিমানবাবুর বিরুদ্ধে মানহানির মামলার হুমকি দেন। এই আচরণকে ‘গুরুতর শৃঙ্খলাভঙ্গ’ হিসাবেই দেখেছিল আলিমুদ্দিন। তা ছাড়া, সাসপেন্ড হওয়া সত্ত্বেও অনিলবাবু যে ভাবে নিজের পথে চলছিলেন, তাতে আলিমুদ্দিনের ‘কর্তৃত্ব’ নিয়েই প্রশ্ন উঠছিল। তিন মাসের মেয়াদ ফুরনোর আগেই তাই অনিলবাবুকে বহিষ্কার করে বিমানবাবু নিজের কর্তৃত্বও প্রতিষ্ঠিত করলেন বলে দলের একাংশের ব্যাখ্যা। |
রবিবার চুঁচুড়ায় নিজের বাড়িতে অনিল বসু। ছবি:তাপস ঘোষ |
আরামবাগের এক কালের ‘দাপুটে’ নেতার বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে, সেই প্রসঙ্গে এত দিন গোপনীয়তা বজায় রেখে চলছিলেন সিপিএম নেতৃত্ব। তাঁকে বহিষ্কারের সিদ্ধান্ত অবশ্য প্রথা মেনেই ঘোষণা করা হয়েছে। কেন্দ্রীয় কমিটির অনুমোদন পাওয়ার পরে রাজ্য সম্পাদক বিমানবাবু এ দিন এক বিবৃতিতে জানান, মদন ঘোষের নেতৃত্বে এবং মহম্মদ সেলিম ও নৃপেন চৌধুরীকে নিয়ে গঠিত তিন সদস্যের কমিশন অনিলবাবু সম্পর্কে কিছু অভিযোগের অনুসন্ধান করে তাঁকে সাসপেন্ড করার সুপারিশ করেছিল। সেই অনুযায়ী রাজ্য কমিটি তাঁকে তিন মাসের জন্য প্রাথমিক সদস্যপদ থেকে সাসপেন্ড করে। বিবৃতিতে বলা হয়েছে, ‘শাস্তিপ্রাপ্ত অবস্থাতেই তিনি ৪ মে স্ত্রীকে নিয়ে সাংবাদিক সম্মেলন ডেকে গুরুতর পার্টি-শৃঙ্খলাবিরোধী কাজ করেন। প্রকাশ্যে ওই পার্টি-বিরোধী বক্তব্যের পরিপ্রেক্ষিতে পার্টির শৃঙ্খলাভঙ্গের অভিযোগে ৬ জুন পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য কমিটির সভায় অনিলবাবুকে পার্টি থেকে বহিষ্কারের সুপারিশ করা হয়। ওই সুপারিশ কেন্দ্রীয় কমিটির ৯-১০ জুনের বৈঠকে অনুমোদিত হয়’।
দল একেবারে ছেঁটে ফেলার পর অনিলবাবুকে খানিকটা ‘স্তিমিত’ দেখিয়েছে। তবে তাঁর দাবি, “দলই আমায় অনিল বসু করেছে। দল থেকে যা পেয়েছি, তাতে আমি কানায় কানায় পূর্ণ। ৪৫ বছর পরে দল যা কেড়ে নিল, তাতে আমার ক্ষতি হয়নি।” তাঁর আরও বক্তব্য, “দলই শিখিয়েছে, গরিবের জন্য কাজ করতে। তা-ই চালিয়ে যাব। দলীয় পতাকা কারও ব্যক্তিগত নয়।” জানিয়েছেন, আজ, সোমবার থেকে দিল্লিতে কিষাণ সভার কেন্দ্রীয় কাউন্সিলের বৈঠকে যাচ্ছেন না। অনিলবাবুর কথায়, “বেহায়া নই যে, সেখানে গিয়ে হাজির হব!”
নিজের ‘বিদ্রোহী’ ভাবমূর্তি ধরে রাখার চেষ্টা অবশ্য অব্যাহত রেখেছেন সাত বারের সাংসদ। ‘সদ্যপ্রাক্তন’ দলের নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তাঁর কটাক্ষ, “দাসতন্ত্রের বিরুদ্ধে গেলে গ্ল্যাডিয়েটরের মতো বধ হতে হবে! দলের দাসত্ব-প্রথা মেনে চলতে পারলেই নেতা হয়ে থাকতে পারবে! আমাদের রাজ্যের দলের যা বর্তমান পরিস্থিতি, তাতে বোঝা যাচ্ছে আগামী দিনে খুব খারাপ সময় আসছে!”
কেন্দ্রীয় কমিটির এই বৈঠকেই সিপিএমের সাধারণ সম্পাদক প্রকাশ কারাট জানান, কেরলের দুই নেতা এম এম মানি এবং গোপী কোট্টামুরিক্কালের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। তবে ভি এস অচ্যুতানন্দনের বিষয়ে কেন্দ্রীয় কমিটি কোনও সিদ্ধান্ত নেয়নি। চলতি মাসের শেষে ফের কেরলে রাজ্য কমিটির বৈঠক ডাকা হয়েছে, যেখানে বিষয়টি আলোচনা হওয়ার কথা। কেন্দ্রীয় কমিটিতে বলতে গিয়ে ভি এস অবশ্য রাজ্য নেতৃত্বের দল পরিচালনা নিয়ে প্রশ্ন তুলে নেতৃত্বে রদবদলের দাবি ফের সামনে এনেছেন। |