শনিবারের নিবন্ধ
চৌরঙ্গী-র জন্মভূমিতে
দ্রুতই আমরা একমত হলাম, লর্ড কার্জনের বিরুদ্ধে বাঙালি অবশেষে প্রতিশোধ নিতে সক্ষম হয়েছে!
কার্জন সেই কবে ১৯০৫-এ দ্বিখণ্ডিত করেছিলেন বাঙালিকে। আর এই ২০১২-তে বাঙালি কিনা কার্জন পার্ক-কেই দ্বিখণ্ডিত করে ছেড়েছে। এক দিকটা ঘাস। এক দিকটা ধুলো আর সারি সারি রেলিং। ‘চৌরঙ্গী’ উপন্যাসের প্রোটাগনিস্ট তাঁর আঁতুড়ঘরের দিকে এগোতে এগোতে বার কয়েক নস্টালজিয়ায় আচ্ছন্ন হব হব। “ট্রামগুমটি তখনও ছিল। ঘোড়াগুলোকে শুধু এখানে পরিচর্যা করা হত। যারা ট্রামটাকে টানত টালিগঞ্জ অবধি... কাশী বিশ্বনাথ সংঘের ট্যাঙ্কার থেকে এই জায়গাটায় জল দিত। বেকার দেখে মায়াদয়া হলে সঙ্গে একটা বাতাসা।” নস্টালজিয়ার নেটওয়ার্ক অবশ্য দ্রুতই উড়ে গেল পারিপার্শ্বিকে। “পার্কটা আগেও দুর্দান্ত পরিচ্ছন্ন কিছু ছিল না। জ্যোতিষী বসত। বুটপালিশওয়ালা। দেহপসারিণীরা ঘুরত। কিন্তু এত ধুলো, এত সব রেলিং ছিল না। এখন তো শুনছি এক হাজার ইঁদুরও মাটির তলায় থাকে,” বললেন আতঙ্কিত শংকর।
সন্ধে পৌনে সাতটা। এতই ক্ষতবিক্ষত করা গরম, সন্ধে না মাঝ দুপুর গুলিয়ে যেতে পারে। যেমন পাঠকের গুলিয়ে যায় ‘চৌরঙ্গী’ আসলে কোন হোটেলকে কেন্দ্র করে লেখা? এমনিতে জুনের আরও একটা স্বাভাবিক দিন যাকে অস্বাভাবিকতার মাত্রা দিতে স্রষ্টা নিজে চলেছেন ৫০ বছর পর তাঁর সৃষ্টির উৎসমুখে। ‘দেশ’ পত্রিকায় ধারাবাহিক চলতে চলতে ‘চৌরঙ্গী’ বই হয়ে বেরোয় ১৯৬২-তে। আমরা যে শ্বেতপাথরের স্ট্যাচুর সামনে দাঁড়িয়ে আপাতত কার্জন পার্ক ভ্রমণ স্তব্ধ করেছি তাঁর জন্ম ঠিক একশো বছর আগে। স্যার হরিরাম গোয়েঙ্কা বাহাদুর। ইনি শিকাগো ধর্ম মহাসভা থেকে স্বামীজি ফেরার পর শিয়ালদহ স্টেশনে তাঁকে অভ্যর্থনা জানাতে গিয়েছিলেন। ‘চৌরঙ্গী’র সঙ্গে প্রাসঙ্গিকতা অবশ্য সে জন্য নয়। উপন্যাসের নায়ক অসহায় বেকারিত্বের মধ্যে রাজভবনের বিপরীতে এই স্ট্যাচুর তলায় বসে দিন গুজরান করত। আর মূর্তির কাছে প্রার্থনা করত। ফিল্মে যে চরিত্রটাকে চিরবিখ্যাত করে রেখেছেন শুভেন্দু চট্টোপাধ্যায়। হঠাৎই তার সামনে হাজির হয়ে যায় অ্যাটাচি কেস হাতে কোট-প্যান্ট পরা পূর্ব-পরিচিত এক সাহেব। নাম বায়রন। বায়রন সাহেবই শাজাহান হোটেলে নিয়ে গিয়ে চাকরি জুটিয়ে দেন শংকরের।
এখন ব্যাঙ্ক হয়ে যাওয়া সেই স্পেনসেস হোটেলের সামনে
স্যার হরিরামের পাদদেশে বসে ৫০ বছর পর লেখকের স্বীকারোক্তি, “আসলে গল্পের শুরুটা এখানে নয়। বইতে যা-ই থাক, ‘চৌরঙ্গী’-র প্রথম দৃশ্য হওয়া উচিত কে. সি. দাশের দোকানের বাইরে।” প্রচণ্ড একটা ধাক্কাই লাগল বলা যায়। এতটা ‘মেক বিলিভ’! যাকে পাত্তা না দিয়ে লেখক বলে গেলেন, “বৃষ্টি পড়ছিল সেদিন। গাড়িবারান্দার তলায় দাঁড়িয়ে নীচের একটা বইয়ের দোকানে বই উল্টোচ্ছি। হঠাৎ লাইনগুলো চোখে এল:
‘Our life is but a winter’s day:
Some only breakfast and away;
Others to dinner stay and are full fed;
The oldest man but sups and goes to bed;
He that goes soonest has the least to pay.’

সামনে বৃষ্টির মধ্যে গ্র্যান্ড হোটেলের মাথাটা ভেসে উঠে একটা অপূর্ব মাত্রা যোগ করেছে। দ্রুত মাথায় খেলে গেল, ‘আরে আমার তো হোটেলে এত সব অভিজ্ঞতা। হোটেল নিয়ে বই লিখলে কেমন হয়?’” ‘কত অজানারে’র চমকপ্রদ আবির্ভাবী সাফল্যের পর শংকর তখন দ্বিতীয় বইয়ের বিষয় কী হবে, চূড়ান্ত হাবুডুবু খাচ্ছেন। চারপাশে ব্যঙ্গ-বিদ্রুপও চলছিল ‘আরে এ মালটা ওয়ান-বুক অথর’।
পাঁচ লাইনের একটা ইংরেজি উদ্ধৃতি আর বর্ষার সিলুয়েটে গ্র্যান্ড হোটেল— অন্তঃসত্ত্বা হয়ে গেল ‘চৌরঙ্গী’ উপন্যাস। কে জানত সেদিন গঙ্গা থেকে টেম্স— একদিন সর্বত্র সেই সন্তানের মহিমা ছড়িয়ে পড়বে?
কিন্তু শাজাহান হোটেলটা কি তা হলে গ্র্যান্ড? আগে যে শোনা যেত গ্রেট ইস্টার্ন? ফিল্মটা তো শোনা যায় গ্র্যান্ডে শ্যুটিং হয়েছিল। শংকর তা হলে কোথায় কাজ করতেন? সব গুলিয়ে যাচ্ছে।
এই মুহূর্তে উত্তর দেওয়ার অবকাশ নেই। মুখে রহস্য জড়ানো হাসি এনে শংকর বললেন, “কোনওটাই না।” উপন্যাসের প্রকৃত উৎপত্তিস্থলের দিকে এবার আমরা ধাবমান। সাবেকি ওয়েলেসলি প্লেস। রাজভবনের সিংহদুয়ার থেকে হাঁটা দূরত্ব। সাদা বাড়িটা দেখলে মনে হওয়ার কোনও উপায় নেই এমনকী আধুনিক আমলেও পশ্চিমী সমাজে তোলপাড় ফেলে দেওয়া অনূদিত উপন্যাসের জন্মভূমি এই জায়গাটা যে হতে পারে!
দু’-দু’টো ব্যাঙ্ককে ঘাড়ে বইছে সে এখন— ইউকো আর সেন্ট্রাল। পাশে এটিএম এবং ‘বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড’-এর অফিস। এতই গতানুগতিক, নিত্যনৈমিত্তিক চেহারা রং চটে যাওয়া সাদা বাড়িটার যে ওই লোকেশনে একদা রামধনু-রঙা আবেগ তৈরি হতে পারে! এত নাচ, এত গান, এত দুঃখ— হাজারো আলোর এমন ঝাড়বাতি থাকতে পারে ভাবাই যায় না।
কে. সি. দাশ থেকে অতটা রাস্তা ঘাম জবজবে গরম আর ভিড়ের যৌথ আক্রমণকে সহ্য করে পৌঁছতে, পৌঁছতে যথেষ্ট ক্লান্ত লাগছে। উনআশি বছরের ঔপন্যাসিকের তো শার্ট ঘামে জবজবে। কিন্তু স্পটটার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তিনি যেন নিমেষে ষাট বছরেরও বেশি ফিরে গিয়েছেন। ঘাম কোনও ফ্যাক্টরই হচ্ছে না। আনমনে বললেন, “কাঠের সিঁড়ি ছিল। নীচটা রিসেপসন। বাঁ পাশে লিফ্ট। ছাদে ক্যাবারে হত। আমরা ওই লিফ্টটা দিয়ে ওপরে উঠতাম।”
দৃশ্যান্তরে যেন ১৯৫০-এর কলকাতা। যখন হাইকোর্টে ব্যারিস্টার নোয়েল বারওয়েলের বাবু শংকর তাঁর সাহেবের সঙ্গে এখানে নিয়মিত দেখা করতে আসতেন। বেশি দেরি হয়ে গেলে রাতে বার কয়েক থেকেওছেন। হোটেলের নাম ছিল স্পেনসেস। এই-গল্পের শাজাহান হোটেল। পাছে হোটেল কর্তৃপক্ষ মামলা-টামলা করেন সেই ভয়ে লেখক স্বদেশী নাম বাছেন। বহু বছর তাঁর ভয় কাটেনি যে কোথাও হোটেলের আইডেন্টিটি বেরিয়ে যায়নি তো?
টানা দু’বছর বারওয়েল এখানে ছিলেন। তাঁর মৃত্যুর পর শ্রীমতী বারওয়েলও স্পেনসেসে দীর্ঘদিন কাটিয়ে যান। টিন-এজ ছাড়িয়ে যৌবনে পড়া শংকর তখনও নিয়মিত আসতেন তাঁর সঙ্গে দেখা করতে। পশ্চিমবঙ্গের রাজ্যপাল পদ্মজা নায়ডু। বারওয়েলদের পারিবারিক বন্ধু। হোটেল থেকে হাঁটা দূরত্বের রাজভবনে প্রায়ই গিয়ে চা খেয়ে আসতেন মিসেস বারওয়েল। ‘চৌরঙ্গী’ বই হয়ে বার হয়েছে খবর পাওয়ার অনেক বছর পরে তিনি ইহজগৎ ত্যাগ করেন। অবশ্য জেনে যেতে পারেননি তাঁর নিজের দেশে পেঙ্গুইন ইংরেজি সংস্করণ বার করার পরে কী পরিমাণ জনপ্রিয়তা স্পেনসেস হোটেলের দৃশ্যপট পেয়েছে। পরে তা অনূদিত হয়েছে ইতালিয়ানে। বিবিসি চ্যানেল ফোর-এ নাটক হয়েছে। শিগ্গির-ই ফরাসি ভাষায় অনূদিত হচ্ছে। স্পেন আর চিনে শিগ্গির-ই ছড়িয়ে পড়বে।
কী রহস্যময়তা আছে পঞ্চাশ দশকের ঘোড়ায় টানা ট্রামের কলকাতার লুপ্ত হোটেলের যে আজও আধুনিক ইন্টারনেটের জেটসেট পশ্চিমী পৃথিবীতে তাকে নিয়ে মানুষ আন্দোলিত হয়? নামী ইংরেজ সমালোচক লিখেছেন, ‘‘চৌরঙ্গী’ ইজ আ টোয়েন্টিয়েথ সেঞ্চুরি আরবান ফেয়ারি টেল। ইট কুড হ্যাভ হ্যাপেন্ড এনিহ্যোয়্যার ইন দিস ওয়ার্ল্ড।’ ‘গার্ডিয়েন’ পত্রিকা বলেছে, ‘‘চৌরঙ্গী’: আ লাভলি চার্মিং বুক, ব্রিমিং উইথ লাইফ অ্যান্ড ফুল অফ দ্য আনএক্সপেকটেডনেস অফ অ্যা ক্লোজলি অবজার্ভড ওয়ার্ল্ড।’
কিন্তু এই মুহূর্তে নিকুচি করেছে শক্ত শক্ত ওই সব ইংরেজি উদ্ধৃতি নিয়ে ভাবতে। জনপ্রিয়তা আন্দাজে দুই বাংলার বাঙালিদের বরঞ্চ অনেক অসমাপ্ত জিজ্ঞাস্য আছে। ‘গার্ডিয়েন’-এর আঁতেল বুক রিভিউয়ের চেয়ে সেই সহজ প্রশ্নগুলো বেশি ইম্পর্ট্যান্ট।
• স্পেনসেস হোটেলের চাকরিতে কবে ঢুকলেন শংকর?
• ছিলেনই বা কত দিন?
• স্যাটা বোসকে সেখানেই পেলেন?
• বইয়ের বাকি চরিত্রগুলোও সেখানেই হাজির ছিল?
মরমি অ্যান্টিক্লাইম্যাক্স। কেন না নিচু গলায় লেখক বললেন, “একদিনও চাকরি করিনি। হোটেলে নিয়মিত যাতায়াতের সুবাদে অনেক কিছু জানা ছিল। বাকিটা প্রচুর দৌড়ঝাঁপ আর রিসার্চ করে জেনে নিই।” বাঙালির বহু দশকের সযত্ন-চর্চিত মিথ যেন ওই সন্ধে-রাতের মিলনস্থলে অবসৃত ওয়েলেসলি প্লেসে ভেঙে পড়ল!
কিন্তু স্যাটা বোস কে? প্রশ্নটা তো থেকেই গেল। সত্যি এই হোটেলে কাজ করতেন? মিসেস পাকড়াশি কি যাঁকে শোনা যায়, সেই বহুবিখ্যাত সোস্যালাইট মহিলা? নিত্যহরিবাবু— বাঙালির আরেক অবিস্মরণীয় চরিত্র? সুজাতা মিত্র নামে সত্যি কোনও এয়ারহোস্টেস ছিলেন?
সৃষ্টির অর্ধ-শতাব্দী পরেও লেখককে দেখে মনে হল জাদু-ভাণ্ডার সম্পূর্ণ উন্মুক্ত করে দিতে চান না। ভাসা, ভাসা কিছু উত্তর দিলেন। যেগুলো জুড়ে একটা বিশ্বাসযোগ্য ছবি কখনওই হয় না। রহস্য ভাঙে অথচ ভাঙে না। সেই আলোছায়া আবছায়া। আগের চেয়ে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। কিন্তু স্পষ্ট নয়। বোঝাই যাচ্ছে, পুরোপুরি স্পষ্ট করাতে স্রষ্টার আগ্রহ নেই। ফিরতি পথ-পর্যটনে রাজভবনের নুড়িগুলোর পাশ দিয়ে যেতে যেতে মনে হল বইয়ের উপসংহারটা আজও সত্যি।
‘শাজাহানের (স্পেনসেস) ক্লান্তিহীন লাল-আলো তখনও জ্বলছে আর নিভছে।
আমরা এগিয়ে চললাম।’


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.