উদ্বেগ গবেষকদের
ভূমিক্ষয়-রোধী উদ্ভিদ ধ্বংস অবাধে, সঙ্কটে সৈকতকেন্দ্র
রাজ্যে পালাবদলের পর মুখ্যমন্ত্রী হয়েই মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় পূর্ব মেদিনীপুরের সমুদ্র উপকূলবর্তী সৈকত পযর্টন-কেন্দ্র দিঘাকে গোয়ার ধাঁচে গড়ে তোলার ঘোষণা করেছিলেন। পরে দিঘায় সমুদ্র উৎসবের উদ্বোধনে এসে তাজপুর-মন্দারমনি সৈকতও নিজে ঘুরে যান। পাশাপাশি থাকা সৈকত-কেন্দ্রগুলির সামগ্রিক উন্নয়নে জোর দেন মুখ্যমন্ত্রী। সুন্দর সৈকতের শর্তে যাবতীয় নিয়ম-বহির্ভূত নির্মাণ বন্ধেরও নির্দেশ দেন তিনি। কিন্তু নির্দেশই সার। অবৈধ নির্মাণ বন্ধ হয়নি বলেই অভিযোগ উপকূলীয় এলাকার ভূমিক্ষয় ও জীব-বৈচিত্র নিয়ে গবেষণারত বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা।
দিঘার লাগোয়া সৈকত পযর্টনকেন্দ্র মন্দারমনির সমুদ্র সৈকতে অবৈধ নির্মাণ, সমুদ্রতটে মোটরযান চলাচল, আর প্রশাসনিক উদাসীনতার জেরে ভূমিক্ষয়-রোধকারী উদ্ভিদের ব্যাপক সংখ্যা হ্রাস ঘটছে বলেও উদ্বেগ প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদবিদ্যা বিভাগের গবেষকদলটি। বিদ্যাসাগর বিশ্ববিদ্যালয়ের উদ্ভিদ ও বনবিদ্যা বিভাগের প্রাক্তন প্রধান ও ইউজিসি-র ‘স্পেশ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স প্রোগ্রামে’র ডেপুটি কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক অমলকুমার মণ্ডল এবং কলকাতার লেডি ব্রেবোর্ন কলেজের জীববিদ্যা বিভাগের প্রধান সংযুক্তা পারুইয়ের অধীনে একদল তরুণ গবেষক দীর্ঘ পাঁচ বছর ধরে ওড়িশার ভিতরকণিকা থেকে চাঁদবালি, তালসারি, উদয়পুর, দিঘা, শঙ্করপুর, তাজপুর ও মন্দারমনি পর্যন্ত ৩২৫ কিলোমিটার বিস্তীর্ণ এলাকায় গবেষণার কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা লক্ষ করেছেন, তাজপুর ও মন্দারমনি সৈকত এলাকায় জীববৈচিত্রের হ্রাস ঘটছে খুবই দ্রুততার সঙ্গে। নিত্য হোটেল-রিসর্ট গজিয়ে উঠছে। সিমেন্টের খুঁটি পুঁতে জায়গা দখলেরও রীতিমতো প্রতিযোগিতা চলছে। গবেষকদলের প্রধান অধ্যাপক অমলকুমার মণ্ডলের অভিযোগ, “সমুদ্রতীরের ভূমিক্ষয়-রোধকারী দুটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্ভিদ আইপোমিয়া বাইলোবা ও স্পিনিফেক্স স্কোয়ামোসাস—যা সৈকতের বালির মধ্যে কার্যত মুখ গুঁজে থাকে--তা সমুদ্রতীরে হোটেল-রিসর্ট গড়ার জন্য কোথাও ছেঁটে ফেলা হয়েছে। আবার কোথাও পুড়িয়ে ফেলা হচ্ছে। নির্বিচারে ধ্বংস করা হচ্ছে এই প্রাকৃতিক সম্পদকে।”
গবেষকদলের তিন গবেষক অমলবাবু, সংযুক্তাদেবী এবং তমাল চক্রবর্তীর এ-সংক্রান্ত এক গবেষণা-প্রতিবেদন ‘আফ্রিকান জার্নাল অব প্ল্যান্ট সায়েন্স’ পত্রিকায় চলতি বছরের ২৭ জানুয়ারি (ভল্যুম ৬/২) সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে। গতবছর ২৩ থেকে ৩০ জুলাই অস্ট্রেলিয়ার মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে আয়োজিত ১৮তম আন্তর্জাতিক উদ্ভিদবিদ্যা সম্মেলনেও অমলবাবু এই উদ্বেগজনক বিষয়টি তুলে ধরেন। তাঁর কথায়, “ভূমিক্ষয়-রোধ করার জন্য সমুদ্র সৈকত সংলগ্ন এলাকায় কৃত্রিম ভাবে লাগানো অন্যান্য উদ্ভিদের তুলনায় ‘আইপোমিয়া বাইলোবা’ ও ‘স্পিনিফেক্স স্কোয়ামোসাস’ অনেক গুরুত্বপূণর্র্ ভূমিকা নিতে পারে। এবং এরা সমুদ্রতীরে প্রাকৃতিক ভাবেই জন্মায়।” অমলবাবু আরও জানান, ভৌগোলিক বিচারে সামুদ্রিক অঞ্চলকে তিন ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন, সমুদ্রের দিক থেকে যে অঞ্চল রয়েছে তাকে বলা হয় সি-ওয়ার্ড জোন বা হ্যালোফাইট অঞ্চল। তার পরে থাকে মেসোজোন বা রাইজোফোরা অঞ্চল। আর সবশেষে সমুদ্র-পাড়ে বা লোকালয়ের দিকে থাকে ল্যান্ড-ওয়ার্ড বা ম্যানগ্রোভ অ্যাসোসিয়েটেড অঞ্চল। দিঘা মন্দারমনি, তাজপুর বা উদয়পুরে সুন্দরবন বা ভিতরকণিকার মতো ম্যানগ্রোভের দেখা পাওয়া যায় না। যেহেতু এই সব এলাকায় কোন ব-দ্বীপ অঞ্চল গড়ে ওঠেনি। কিন্তু ম্যানগ্রোভ অ্যাসোসিয়েটেড অঞ্চল হিসেবে এই সব এলাকায় ‘অ্যাকানথাস ইলিসিফোলিয়াস’, ‘প্যান্ডানাস ফেসিকুলারিস’, ‘কৃনাম’, ‘কেনাভেলিয়া লিনেটা’, ‘কেনাভেলিয়া চাইনেনসিস’ প্রভৃতির সঙ্গেই রয়েছে ‘আইপোমিয়া বাইলোবা’ ও ‘স্পিনিফেক্স স্কোয়ামোসাস’ উদ্ভিদ। যারা ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ভূমিক্ষয় রোধ করতে পারে। কিন্তু গত দু-তিন বছরে এই সব এলাকায় চলছে অবৈধ ভাবে হোটেল-রিসর্ট তৈরির কাজ। সমুদ্র-সৈকতের কত কাছে কে হোটেল-রিসর্ট গড়ে তুলবে, তাই নিয়ে চলছে প্রতিযোগিতা। পাল্লা দিয়ে চলছে সৈকতের উপর দিয়ে যথেচ্ছ মোটরযান চলাচল। যার ফলে এই দুই উদ্ভিদের যে বীজ উৎপন্ন হয়, সে-গুলি অঙ্কুরিতই হতে পারছে না। এমনকী বিলুপ্ত হতে বসেছে সৈকতে বিচরণকারী লাল-কাঁকড়ার প্রজাতিও।
বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকদলের সদস্য তমাল চক্রবর্তী,পীযূষকান্তি দাস, অসীম মণ্ডল, মমতাজ খাতুন, দেবাশিস ভূঁইয়া, সৌরভ দুয়ারি, বাবুলাল শাসমল ও মহম্মদ আবু ইমাস সাদী এই ভূমিক্ষয়-রোধকারী উদ্ভিদগুলিকে চিহ্নিত করার পাশাপাশি এদের সংরক্ষণে স্থানীয় ভাবে সচেতনতা বৃদ্ধির জন্যও লাগাতার প্রয়াস চালাচ্ছেন। কিন্তু প্রশাসনিক উদাসীনতায় সেই উদ্যোগ মাঠে মারা যাচ্ছে বলে অভিযোগ। অমলবাবুর আক্ষেপ, “ভুমিক্ষয়-রোধকারী এই উদ্ভিদ সংরক্ষণে স্থানীয় গ্রাম পঞ্চায়েত থেকে শুরু করে পঞ্চায়েত সমিতি, জেলা পরিষদ, এমনকী দিঘা-শঙ্করপুর উন্নয়ন পর্ষদেরও কোনও হেলদোল বা চিন্তাভাবনা নেই। অথচ বিদেশে সমুদ্র তটভূমি রক্ষায় সেখানকার সরকারের পক্ষ থেকে এই ধরনের উদ্ভিদ লাগানোর পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণেরও ব্যবস্থা করা হয়। আর এখানে চলছে প্রকৃতির সংহার, অবৈধ কারবার।”
মুখ্যমন্ত্রীর ঘোষণা-নির্দেশ কাগুজে হয়েই রয়ে যাচ্ছে বলে উদ্বিগ্ন প্রকৃতিপ্রেমীরা। সৈকতের ভূমিক্ষয়ে আগামী দিনে বড় বিপদ অপেক্ষা করছে বলেও আশঙ্কা। ভূমিক্ষয়-রোধকারী উদ্ভিদ বাঁচাতে এখনই প্রশাসনিক উদ্যোগ শুরু না হলে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা করছেন গবেষকেরা। এমনকী বিলীন হয়ে যেতে পারে দিঘা-মন্দারমনি-তাজপুরের সোনালি সৈকত।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.