|
|
|
|
|
|
|
চিত্রকলা ও ভাস্কর্য ১... |
|
বৈচিত্রের মধ্যেও ফুটে ওঠে ঐক্যের প্রকৃত স্বরূপ |
সম্প্রতি অনুষ্ঠিত হল রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার-এর বার্ষিক প্রদর্শনী। লিখছেন মৃণাল ঘোষ। |
রামকৃষ্ণ মিশন ইনস্টিটিউট অব কালচার-এর এই বছরের বার্ষিক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হল সম্প্রতি। শ্রীরামকৃষ্ণের ১৭৫তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে তাঁর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি হিসেবে নিবেদিত হয়েছে এই প্রদর্শনী। অতীতের ও বর্তমানের বহু শিল্পী ছবি ও ভাস্কর্যে শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন এই মহামানবের প্রতি। মোট ৮২টি কাজ ছিল।
এই প্রদর্শনীতে মণীন্দ্রভূষণ গুপ্ত বা রামকিঙ্করের মতো নব্য-ভারতীয় ঘরানা বা শান্তিনিকেতন ঘরানার শিল্পীর ছবি বা ভাস্কর্য যেমন রয়েছে, তেমনই রয়েছে প্রাচ্য-পাশ্চাত্যের সমন্বয়বাদী ১৯৪০-এর দশকের প্রতিভূস্থানীয় শিল্পী পরিতোষ সেনের ছবি। আবার সমকালীন শিল্পীদের মধ্যে স্বাভাবিকতাবাদী আঙ্গিকে কাজ করেন যাঁরা, শুভাপ্রসন্ন, নভেন্দু সেন, ওয়াসিম কাপুর, সঞ্জয় ভট্টাচার্য, সুব্রত গঙ্গোপাধ্যায় প্রমুখ শিল্পীর ছবিও রয়েছে। আবার তরুণতর প্রজন্মের পার্থ দাশগুপ্ত, অতনু ভট্টাচার্য, অতীন বসাক, যাঁদের কাজে থাকে সাম্প্রতিক বিকল্প রূপকল্পের ইঙ্গিত, তাঁরাও শ্রদ্ধা নিবেদন করেছেন এই সন্তের প্রতি। সকলের কাজেরই প্রকাশভঙ্গি আলাদা। কিন্তু সেই বৈচিত্রের মধ্যেও একটি ঐক্যের আবহ অনুভব করা যায়। অধ্যাত্ম চেতনার প্রকাশ যেমন সেই ঐক্যের একটি মাত্রা, তেমনই জাতীয় আত্মপরিচয়ের একটি আবহও উঠে আসে তা থেকে। সেই আত্মপরিচয়ের মধ্যেই ‘আন্তর্জাতিকতা’-ও প্রাসঙ্গিক হয়ে ওঠে। এখনও ক্ষমতা ও রাজনীতির দ্বন্দ্বে বিভাজিত বিশ্বে নিজস্ব জাতীয়তার শিকড়ে সংবদ্ধ না থাকলে আরোপিত আন্তর্জাতিকতা বায়বীয় হয়ে যায়। এই প্রদর্শনীটি আমাদের বুঝতে সাহায্য করল প্রকাশের বৈচিত্রের মধ্যেও সাংস্কৃতিক মননের সেই ঐক্যের স্বরূপ। এদিক থেকেই এই প্রদর্শনী বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ।
রামকিঙ্করের টেরাকোটার ডিম্বাকৃতি রিলিফ ভাস্কর্যটিতে শ্রীরামকৃষ্ণের ধ্যানমগ্ন মুখাবয়বের রূপায়ণ। চৈতন্যের তন্ময়তার প্রতীক হয়ে উঠেছে স্বাভাবিকতা ও ধ্রুপদী অনুষঙ্গের সমন্বয়ে গড়ে ওঠা এই মুখাবয়ব। উমা সিদ্ধান্তের ব্রোঞ্জ-ভাস্কর্যে রামকৃষ্ণই কল্পবৃক্ষে রূপান্তরিত হয়েছেন। নিরঞ্জন প্রধানের ব্রোঞ্জ-ভাস্কর্যের শিরোনামও ‘কল্পতরু’। ঐতিহ্য ও আধুনিকতার সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে তাঁর আঙ্গিক। বিমল কুণ্ডুর ভাস্কর্যের শিরোনাম ‘সমাধি’। দণ্ডায়মান ধ্যানমগ্ন সন্তের মূর্তি গড়েছেন তিনি।
|
|
শিল্পী: নভেন্দু সেন |
এই প্রদর্শনীর বিশেষ একটি আকর্ষণ লিথোগ্রাফে করা তিনটি ‘পপুলার প্রিন্ট’, যাতে রামকৃষ্ণের জীবনের বিভিন্ন দিকের আলেখ্য রূপায়িত। শিল্পের মাধ্যমে ধর্মীয় সংস্কৃতির সঙ্গে সাধারণ মানুষের সংযোগের সেতু এই ‘পপুলার প্রিন্ট’। মণীন্দ্রভূষণ গুপ্ত এঁকেছেন কল্পবৃক্ষের ছবি। মৃণালকান্তি দাসের ছবিতে রামকৃষ্ণকে ঘিরে পৌরাণিক নানা চরিত্রের সমাবেশ। নব্য-ভারতীয় ঘরানার অধ্যাত্মচেতনা-আশ্রিত রূপরীতির সমৃদ্ধ প্রকাশ এখানে। এরই বিভিন্ন প্রকাশ দেখা যায় ধীরেন ব্রহ্ম, অমল চাকলাদার, অজয় ঘোষ থেকে শুক্তিশুভ্রা প্রধান বা রতন আচার্যের ছবিতে। এই বিবর্তনের মধ্যে নব্য-ভারতীয় ঘরানা যে পরবর্তী আধুনিকতার নানা মাত্রাকে আত্মস্থ করে তার পরিচয় পাওয়া যায় তাপস কোনার বা অতীন বসাকের ছবিতে। স্বাভাবিকতার আঙ্গিক কী ভাবে নব্য-ভারতীয় ঐতিহ্যকে আত্মস্থ করে তার পরিচয় রয়েছে নভেন্দু সেনের ছবিটিতে। যোগেন চৌধুরী, শুভাপ্রসন্ন বা ওয়াসিম কাপুরের ছবিও এ দিক থেকে প্রাসঙ্গিক।
পরিতোষ সেনের দু’টি ছবি এই প্রদর্শনীতে স্বতন্ত্র মাত্রা এনেছে। রামকৃষ্ণ কথামৃতের দু’টি কাহিনির চিত্রায়ণ এই দু’টি ছবি। একটি বৃষ ও শৃগালের রূপায়ণ। আর একটিতে দেখানো হয়েছে দিঘির পাড়ে বসে বড়শি দিয়ে মাছ ধরছে এক জন। তাঁর এই কাজে যে তন্ময়তা, এ রকম তন্ময়তায় ঈশ্বরের ধ্যান করলেই তাঁকে পাওয়া যেতে পারে। এই হল এই কাহিনির সারাৎসার। শিল্পী ঘনকবাদী বিশ্লেষণাত্মক আঙ্গিকে এই কাহিনিকে রূপ দিয়েছেন, যা নিছক প্রতিকৃতি রূপায়ণের বাইরে শ্রীরামকৃষ্ণের বাণীর বৃহত্তর তাৎপর্যকে বুঝতে সাহায্য করে।
তরুণতর প্রজন্মের শিল্পী পার্থ দাশগুপ্তের ছবিটি প্রতীকী। একটি বাতি জ্বলছে। তার উপর দিয়ে উড়ে যাচ্ছে একটি পাখি। ছবিটির শিরোনাম- ‘ইন সার্চ অব লাইট’। শিল্পী রামকৃষ্ণকে দেখেছেন আলোর সন্ধানে উদ্বুদ্ধ করার এক জন মহামানব হিসেবে। অতনু ভট্টাচার্যের ছবিটির শিরোনাম - ‘আকার নিরাকার’। ঋষির মুখাবয়বের বিমূর্তায়িত রূপ। একবিংশ শতকের মননে শ্রীরামকৃষ্ণের প্রজ্ঞার প্রতিফলন রয়েছে এ রকম আরও কয়েকটি ছবিতে। অংশগ্রহণকারী অন্যান্য শিল্পীদের মধ্যে ছিলেন শানু লাহিড়ি, অশোক মল্লিক, মনোজ দত্ত, তপন মিত্র, দেবব্রত চক্রবর্তী, রামলাল ধর, সোহিনী ধর, অমিতাভ বন্দ্যোপাধ্যায়, সনাতন দিন্দা প্রমুখ। |
|
|
|
|
|