‘কহানি’ ছবির বিদ্যা বাগচিকে মনে আছে? কখনও সাইবার কাফে, কখনও আবার কালিঘাট থানার কম্পিউটারে বসে একের পর এক ‘হ্যাকিং’ করেই সকলকে ঘোল খাইয়ে ছেড়েছিল সে।
সিনেমায় নয়, বাস্তবেই ভারতকে ঘোল খাইয়ে ছাড়তে এ বার যুদ্ধ ঘোষণা করেছে হ্যাকারদের সংগঠন ‘অ্যাননিমাস’। মনমোহন সরকার ইন্টারনেটে বাক্-স্বাধীনতা খর্ব করতে চাইছে এই অভিযোগ তুলে আগামিকাল থেকে তারা লাগাতার ‘অপারেশন ইন্ডিয়া’-র ডাক দিয়েছে। অ্যাননিমাসের হুমকি, সংবাদমাধ্যম, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, জরুরি পরিষেবা বাদে সমস্ত গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ওয়েবসাইট হ্যাক করা হবে।
এমনিতেই সরকারি সাইটগুলির উপর মাসে গড়ে ৪০টির মতো হামলার ঘটনা ঘটছে (জানুয়ারি থেকে মার্চ, তিন মাসে হয়েছে ১৩৩টি), তার উপরে আলাদা করে এই যুদ্ধ ঘোষণায় কপালে ভাঁজ স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের। দেশে সাইবার নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তোলার জন্য বেশ কিছু পরিকল্পনা করেছে কেন্দ্র। এ সবই দীর্ঘমেয়াদি বিষয়। কাল কী হবে, সেই উদ্বেগে এখন কোমর বেঁধে তৈরি হচ্ছে এনটিআরও (ন্যাশনাল টেকনিক্যাল রিসার্চ অর্গানাইজেশন) এবং সার্টইন (ইন্ডিয়ান কম্পিউটার এমার্জেন্সি রেসপন্স টিম)।
হ্যাকারদের এই রণহুঙ্কারের পিছনে রয়েছে কপিল সিব্বলের এক নির্দেশ। ট্যুইটার ও ফেসবুক থেকে নেতানেত্রীদের পক্ষে অবমাননাকর মন্তব্য ও ছবি সরানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন তিনি। এর প্রতিবাদে ইতিমধ্যেই বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ওয়েবসাইট হ্যাক করা হয়েছে। বাদ যায়নি সিব্বলের তথ্যপ্রযুক্তি মন্ত্রকের ওয়েবসাইটও। এই সব সাইটে ‘অ্যাননিমাস’-এর প্রতীক গাই ফক্স-এর মুখোশের ছবি বসিয়ে, লিখে দেওয়া হয়েছে, “এ হল বাক্-স্বাধীনতা খর্ব করার প্রতিশোধ।”
বেসরকারি হিসেবে, গত তিন বছরে ৯ কোটির বেশি ভারতীয় ওয়েবসাইট হ্যাক করা হয়েছে। যার মধ্যে সরকারি সাইট প্রায় সাড়ে পাঁচশো। প্রধানমন্ত্রীর দফতর, বিদেশ মন্ত্রক বা সিবিআই শুধু নয়, যে সংস্থার উপর সাইবার হামলা রোখার ভার, সেই সার্টইন-এর ওয়েবসাইটও আক্রান্ত। গত কয়েক বছর ধরেই এই বিপদ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে আসছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা শিবশঙ্কর মেনন। গত বছর কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা বাহিনীর সঙ্গে রাজ্য পুলিশের ডিজিদের বৈঠকেও তিনি এ বিষয়ে সতর্ক করেন। তাঁর বক্তব্য ছিল, গোয়েন্দা-তথ্য আদানপ্রদানে যতই তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার বাড়ছে, ততই বাড়ছে ঝুঁকি। দু’বছর আগে দিল্লিতে কমনওয়েল্থ গেমসের সময় দু’সপ্তাহে ৮ হাজার সাইবার হামলা হয়। গেমসের টিকিট বিলি, সময় ও স্কোরের হিসেব রাখার ব্যবস্থা অকেজো করে দেওয়ার চেষ্টা হয়। বেশির ভাগ হামলার উৎসই ছিল চিন। অনেক ক্ষেত্রে পাকিস্তানি হ্যাকাররা সরকারি সাইটে ভারত-বিরোধী বক্তব্য লিখে রেখেছে। মেননের মতে, “বিভিন্ন দেশই গুপ্তচরবৃত্তির জন্য হ্যাকারদের সাহায্য নেয়। কিন্তু উইকিলিক্স দেখিয়ে দিয়েছে, সরকারি মদত ছাড়াও হাতে গোনা কয়েক জন ব্যক্তিবিশেষই সরকারের মাথা ব্যথার কারণ হয়ে ওঠার পক্ষে যথেষ্ট।”
ঠেলায় পড়ে দেড়শো কোটি টাকা খরচ করে সাইবার নিরাপত্তা কাঠামো গড়ে তোলার পরিকল্পনা করেছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। যার মধ্যে রয়েছে,
• জাতীয় স্তরে একটি সমন্বয় কেন্দ্র গড়ে তোলা,
• শুধুমাত্র সাইবার অপরাধের তদন্তের জন্যই একটি কেন্দ্র গঠন,
• রাজ্য পুলিশেও এই ধরনের অপরাধের মোকাবিলার পৃথক বিভাগ রাখা,
• সাইবার অপরাধের তদন্ত ও ফরেনসিক পরীক্ষার প্রশিক্ষণ দেওয়ার কেন্দ্র তৈরি, এবং
• এনটিআরও, সার্টইন, ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো, ডেটা সিকিউরিটি কাউন্সিলের মতো সংস্থাগুলির মধ্যে দায়িত্ব আরও স্পষ্ট ভাবে ভাগ করে দেওয়া। আলোচনা করা হচ্ছে সফটওয়্যার সংস্থাগুলির সংগঠন নাসকম-এর সঙ্গেও।
কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে সাইবার হামলা? শিবশঙ্কর মেনন বলছেন, “অজানা বস্তুর আতঙ্কটাই সব থেকে বেশি হয়। সাইবার হামলার ক্ষেত্রেও বিপদটা সেই রকম।” স্বরাষ্ট্র মন্ত্রকের কর্তাদের বক্তব্য, যে সব সাইট এ পর্যন্ত হ্যাক করা হয়েছে, সেগুলি থেকে গোপন সরকারি তথ্য চুরি গিয়েছে কি না, সেটাই জানা যাচ্ছে না। রেল, বিমান, ব্যাঙ্ক, টেলি-যোগাযোগ, বিদ্যুৎ সরবরাহর মতো অধিকাংশ জরুরি পরিষেবার সাইটে কারচুপি করলে বা অচল করে দিলে কার্যত গোটা দেশ অচল হয়ে পড়বে। সরকারি দফতরের কম্পিউটার হ্যাক করা হচ্ছে ই-মেলেও। বিদেশ বা প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের একাধিক কম্পিউটার এ ভাবে হ্যাক করা হয়েছে সম্প্রতি। এই সব কম্পিউটার থেকে তথ্য চুরিও অসম্ভব কিছু নয়। সেনাবাহিনী বা প্রতিরক্ষা মন্ত্রকের কর্তাদের ই-মেল হ্যাক করে সাংবাদিকদের কাছে আজগুবি তথ্য পাঠানোর ঘটনা তো প্রায়ই ঘটছে। কোথায় বসে এ সব করা হচ্ছে, তা জানতেই অনেকটা সময় লেগে যাচ্ছে। আর একটি বড় চিন্তার বিষয় উল্লেখ করেছেন জাতীয় প্রতিরক্ষা গবেষণা ও উন্নয়ন সংস্থা (ডিআরডিও)-র এক কর্তা। তা হল, “এ দেশে সরকারি বা বেসরকারি ক্ষেত্রের প্রায় ৯০ শতাংশ কম্পিউটার হার্ডওয়্যারই বিদেশ থেকে আনানো। এই সব হার্ডওয়্যারে এমন ‘বাগ’ ঢুকিয়ে দেওয়া সম্ভব, যা হয়তো বহু দিন পরে সচল হয়ে তথ্য পাচারের কাজ শুরু করল।”
জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টার মতে, জল,স্থল, আকাশ ও মহাকাশের পরে সাইবার দুনিয়াকেও নতুন যুদ্ধক্ষেত্র হিসেবে ভাবা উচিত। এবং সেই অনুযায়ীই এগোতে চাইছে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্র মন্ত্রক। |