দেশের আর্থিক অবস্থার কি আরও অবনতি হবে? নাকি মন্দাক্রান্ত বিশ্বে শেষ পর্যন্ত ঘুরে দাঁড়াতে পারবে ভারত? আশা-আশঙ্কার এই দোলাচলের মধ্যে বণিকসভা অ্যাসোচ্যামের ইঙ্গিত, অন্ধকারের পিছনেই রয়েছে রুপোলি আলোর রেখা। সিআইআই অবশ্য সংশয়েই। তাদের সমীক্ষা বলছে, চলতি অর্থবর্ষের প্রথম ত্রৈমাসিকে (এপ্রিল-জুন) শিল্পোৎপাদন বৃদ্ধির হার গত বছরের তুলনায় কমবে। এই বিভ্রান্তি ও দোলাচলের মধ্যেই উৎপাদন শিল্পে গতি আনতে বাণিজ্যমন্ত্রী আনন্দ শর্মার নেতৃত্বে উচ্চ পর্যায়ের পর্ষদ গঠন করল কেন্দ্র।
শিল্পোৎপাদনের হারের ক্রমাবনতির সঙ্গেই টাকার ক্রমাগত পতন সব মিলিয়ে দেশের আর্থিক বৃদ্ধির খতিয়ান কাঁপুনি বাড়িয়েছে। ২০১১-’১২ অর্থবর্ষে আর্থিক বৃদ্ধির হার নেমে এসেছে ৬.৫ শতাংশে, গত ন’বছরে যা সর্বনিম্ন।
দেশের বেহাল আর্থিক দশার জন্য কেন্দ্রের দিকেই আঙুল তুলেছে শিল্পমহল। তাদের অভিযোগ, জোটের রাজনীতি ও দুর্নীতির অভিযোগে বেসামাল কেন্দ্র বলিষ্ঠ পদক্ষেপ নিতে ব্যর্থ। সিআইআই সভাপতি আদি গোদরেজের দাবি, ‘নাটকীয় পরিবর্তন’ দেখতে হলে নির্দিষ্ট পদক্ষেপ জরুরি। কৃচ্ছ্রসাধনের মতো ‘প্রতীকী’ পদক্ষেপ নয়।
ঘরে-বাইরে খানিকটা চাপে পড়ে সরকারি-বেসরকারি প্রকল্পের (এক হাজার কোটি টাকার বেশি) দ্রুত রূপায়ণের জন্য গত সপ্তাহে কমিটি গড়েছেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ। এ বার উৎপাদন শিল্পের জন্য তৈরি হল উচ্চ পর্যায়ের পর্ষদ। সরকারি এক মুখপাত্র জানিয়েছেন, উৎপাদন শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্র ধরে এবং রাজ্য স্তরে সে সবের অবস্থা খতিয়ে দেখবে ১৩ সদস্যের ওই পর্ষদ। জাতীয় উৎপাদন নীতির যথাযথ রূপায়ণের জন্য আরও তিনটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি তৈরি হয়েছে। উল্লেখ্য, অর্থবর্ষের শেষ তিন মাসে উৎপাদন সরাসরি কমেছে ০.৩ শতাংশ। (আগের বারের বৃদ্ধি ৭.৩ শতাংশ)।
সংশয়ের মধ্যেই সিআইআই-অ্যাসকন সমীক্ষার পূর্বাভাস, চলতি অর্থ বর্ষের প্রথম তিন মাসে শিল্পোৎপাদনের বৃদ্ধির হার সার্বিক ভাবে কমবে। বৃদ্ধির হার বেশি (১০-২০%), এমন শিল্পের সংখ্যা আগের বছরের এপ্রিল-জুনে ছিল ৩১.৮%। এ বার তা কমে হবে ২৪.৫%। উল্টো দিকে, বাড়বে নড়বড়ে শিল্পের সংখ্যা। যেমন বৃদ্ধির হার কম (শূন্য থেকে ১০%), এমন শিল্পের সংখ্যা আগের বারের চেয়ে বেড়ে দাঁড়াবে প্রায় ৫২.৬%। আর যে সব সংস্থার উৎপাদন বৃদ্ধির হার শূন্যের নীচে, সেগুলির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াবে ১৫.৭%-এ। অথচ খুব ভাল উৎপাদনের আশায় রয়েছে, এমন সংস্থার সংখ্যাটা গত বছরের মতো একই থাকবে। চড়া সুদের হার, নগদ জোগানের অভাব, অত্যাধিক মূল্যবৃদ্ধির হারের জন্য পড়তি চাহিদা, টাকার পতন, রফতানিতে ধাক্কা ইত্যাদি শিল্পোৎপাদনের পথে অন্তরায় বলে মনে করছেন সমীক্ষকেরা। অপ্রতুল পরিকাঠামো, জমি অধিগ্রহণ সমস্যা, এ সব তো রয়েছেই।
শঙ্কার এই কারণগুলিকে উড়িয়ে দিচ্ছে না অ্যাসোচ্যামও। যেমন ব্যবসা বাড়লেও খরচ অনেক বেশি বেড়ে যাওয়ায় মুনাফা কমার সম্ভাবনা রয়েছে বলে মনে করছে তারা। কিন্তু তাদের দাবি, সময়টা কঠিন হলেও একেবারে আঁধারময় নয়। বরং তাদের সমীক্ষায় প্রায় ৬৩% সংস্থার কর্তাই জানিয়েছেন, চার-ছয় মাসের মধ্যে পরিস্থিতির উন্নতি হবে। এবং এ জন্য তাদের কাছে ভরসা স্বাভাবিক বর্ষা। শুধু তাপপ্রবাহ থেকে রক্ষা পেতেই নয়, আর্থিক অবস্থার চাকাটা উল্টো দিকে ঘোরাতেও। অ্যাসোচ্যাম প্রেসিডেন্ট রাজকুমার ধুতের বক্তব্য, এখনও দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৭০% কৃষির উপর নির্ভরশীল। তাই জাতীয় আয়ের ২০ শতাংশের মতো কৃষি থেকে এলেও সার্বিক ভাবে কৃষির প্রভাব অনেক বেশি।
ঘরের পাশাপাশি বাইরের চিত্রটাও তাঁদের আশা জোগাচ্ছে মূলত দু’টি কারণে। প্রথমত, ব্যয়সঙ্কোচনে গ্রিস রাজি হওয়ায় ইউরোপে সঙ্কট কাটার সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। শেষ পর্যন্ত তা বাস্তবায়িত হলে ফের ঝুঁকি নিতে সাহস করবেন লগ্নিকারীরা। দ্বিতীয়ত, এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকায় বিকল্প রফতানির বাজারগুলি মন্দায় খুব বেশি ধাক্কা খায়নি। সব মিলিয়ে প্রায় ৩৯% সংস্থা সমীক্ষায় জানিয়েছে, তাদের বরাত পাওয়ার পরিমাণ বাড়ছে। প্রায় ৫৪% আশা করছে ছ’মাসের মধ্যে ব্যবসাও বাড়বে। সেই রুপোলি রেখার খোঁজেই দিন গুনছে শিল্পমহল। |