গ্রামের নাম জোৎসাদি। পুলিশ দেখলে এখনও চমকে ওঠেন এখানকার মানুষজন। মনে পড়ে যায় বছর দেড়েক আগে একটি শীতের সকালের কথা।
রবিবার সকালেও পুলিশের গাড়ি দেখে ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়েছিলেন অনেকে। সেই গাড়ি গিয়ে দাঁড়াল গ্রামের সদ্য মাধ্যমিক উত্তীর্ণ ছাত্র ফাইয়াজ মল্লিকের বাড়ির সামনে। গাড়ি থেকে নেমে বাড়িতে ঢুকলেন জেলার পুলিশ সুপার সৈয়দ মহম্মদ হোসেন মির্জা। দরিদ্র পরিবারের এই কৃতী ছাত্রের হাতে তুলে দিলেন টাকা, বইপত্র ও শংসাপত্র। তার মায়ের হাতে শাড়ি ও ভাইয়ের হাতে দিলেন মিষ্টির প্যাকেট। সব দেখে হাসি ফুটল বাড়ির সামনে জড়ো হওয়া জনতার মুখে।
পুলিশ সুপার মুখে বলছেন, “দারিদ্রের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করে ফাইয়াজ কৃতিত্ব দেখিয়েছে। ছেলের এই কৃতিত্বের পিছনে রয়েছেন মা-ও। স্বামী তাঁকে ছেড়ে যাওার পরেও তিনি ছেলেদের মানুষ করতে লড়ে গিয়েছেন। এ সব জেনে আর স্থির থাকতে পারিনি। ছুটে এসেছি সংবর্ধনা দিতে।” গ্রামের মানুষ অবশ্য পুলিশের এই উদ্যোগের পিছনে অন্য উদ্দেশ্য দেখতে পাচ্ছেন। |
রায়নার এই গ্রামে ২০১০ সালের ১ ডিসেম্বর নানা মামলায় অভিযুক্ত কয়েক জনকে পুলিশ গ্রেফতার করতে গেলে গ্রামবাসীদের সঙ্গে গণ্ডগোল বাধে। পুলিশ গুলি চালায়। নিহত হন কাজল মোল্লা ও হাসমত আলি শেখ নামে দুই গ্রামবাসী। পুলিশের বিরুদ্ধে গ্রামবাসীরা খুনের অভিযোগ দায়ের করেন। সেই মামলা এখন আদালতে বিচারাধীন। ঘটনার পরে তৎকালীন পুলিশ সুপার রাজারাম রাজশেখরন তড়িঘড়ি তদন্তভার দেন সিআইডি-কে। গত বিধানসভা ভোটের আগে দিল্লি থেকে আসা নির্বাচন কমিশনের পর্যবেক্ষকদের কাছে পুলিশের গুলি চালানো ও তাতে দু’জনের মৃত্যুর অভিযোগে সোচ্চার হয়েছিলেন গ্রামের মানুষ।
সেই ঘটনার পরে পরে পার হয়েছে প্রায় কুড়ি মাস। কিন্তু পুলিশ সম্পর্কে গ্রামের মানুষের ‘আতঙ্ক’ কাটেনি। স্থানীয় তৃণমূল নেতা গোলাম মুস্তাফা মল্লিকের কথায়, “রাজ্যের তৎকালীন শাসক দল সিপিএমের কথা মতো সে দিন গ্রামে পুলিশ গ্রামে ঢুকেছিল। তার পরেই ওই গুলি চালনা ও প্রাণহানি। এ সবের পরে পুলিশ আজ যা করল, তা আমরা সন্দেহের চোখেই দেখছি।” আর এক বাসিন্দা নুরুল মল্লিক বলেন, “ফাইয়াজকে সংবর্ধনা দিয়ে অবশ্য পুলিশ ভাল কাজ করেছে। কিন্তু পুলিশকে নিয়ে আমাদের সন্দেহ রয়েইছে। এ দিনও তাই গ্রামে পুলিশ আসায় মানুষজন অবাক হয়ে যান।” গ্রামের অনেকেই অবশ্য এ দিনের ঘটনা নিয়ে প্রকাশ্যে কোনও মন্তব্য করতে চাননি। নাম প্রকাশ না করার শর্তে কয়েক জন জানান, পুলিশ গ্রামে আসায় তাঁর খানিকটা ভয় পেয়ে যান। পরে ওই হত্যা সংক্রান্ত মামলা প্রত্যাহারের অনুরোধ বা চাপ আসতে পারে, এমন আশঙ্কাও করছেন অনেকে।
গ্রামবাসীদের মনোভাবের কথা অবশ্য পুলিশের অজানা নয়। পুলিশ সুপারের সঙ্গে এ দিন গ্রামে যান এসডিপিও (বর্ধমান দক্ষিণ) অম্লানকুসুম ঘোষ। তাঁর কথায়, “ওই দুই গ্রামবাসীর মৃত্যুর ঘটনা দুঃখজনক। সে দিনটা আমরা ভুলতে চাই।” পুলিশ সুপারও গ্রামে দাঁড়িয়ে বলেন, “পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে এই গ্রামে দু’জনের মৃত্যু ঘটেছিল, সেটা যেমন সত্যি, তেমনই আমাদের সম্পর্কে মানুষের ধারণা যে পাল্টিয়েছিল, সেটাও সত্যি। কিন্তু আমরা মানুষের সঙ্গে নিবিড় সংযোগ গড়ে তুলতে চাই। সে কাজেও এই গ্রামে এসেছি। গ্রামের মানুষের বন্ধুত্ব পেতে আমি আগ্রহী। দেখতে হবে, ওই দিনের ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয়।” |