‘ব’য়ে বাঘের, ‘গ’য়ে গল্প
রসন্ধেবেলা বাগানের ঝোপের কাছে ধুপ করে একটা আওয়াজ হতেই ধলুর মা চেঁচিয়ে ওঠেন ওরে দেখ, দেখ নিশ্চয় বাঁদর। কলাগুলোর রং ধরেছে দেখে খেতে এসেছে দুষ্টুর দল।
শুনেই ও বাড়ির কাজের মেয়ে এলোকেশী, বাংলা সিরিয়ালের সব গল্প যার মুখস্থ, ঝাঁটা হাতে ছুটে এসে বলেছে দাঁড়াও বাঁদরচন্দর, আজ ঝেঁটিয়ে তোমার বিষ না ঝেড়েছি তো...
এলোকেশীর এত রাগের কারণ বাগানের ওই কলাগাছ দু’টি তার নিজের হাতে পোঁতা। বাঁদরের উৎপাতে যার ফলগুলি প্রায়ই নষ্ট হয়।
গ্রামটা মাতলা নদী থেকে কিছুটা দূরে, নাম ঝুপসি। এখানে গাছ আছে, প্রাইমারি স্কুল আছে, আছে বাঁদর, হনুমান আর মানুষ। মাঝে মাঝে কাছের জঙ্গল থেকে বাঘ এসে যে মানুষের ঘরে ঢুকে পড়ে না এমন নয়, কিন্তু সে ন’মাসে ছ’মাসে।
এলোকেশী যখন ঝাঁটা হাতে ধেয়ে যাচ্ছে ঝোপের দিকে, ঠিক তখন সামন্তমশাই পিকুকে নিয়ে হাঁটছিলেন কালু, ধলুদের বাড়ির সামনে দিয়ে।
সামন্তমশায়ের বয়স ছেষট্টি। দুই গালে ঘন দাড়ি। হাতে ছাতা, পরনে ধুতি ও ওভারকোর্ট, যা তাঁর বারোমেসে পোশাক। পিকুর ভাল নাম তমাল। বয়স তেরো। সে পরেছে চকোলেট রঙের ডোরাকাটা শার্ট আর নেভি ব্লু রঙের প্যান্ট। দুটোই সাউথ সিটি থেকে কেনা।
সুন্দরবন দেখতে এসেছেন সামন্তমশাই। তিনি সংসারে একা মানুষ। এ রকম মাঝে মাঝেই বেরিয়ে পড়েন তিনি। এ বার সঙ্গে এসেছেন সুভদ্রবাবু আর গায়ত্রীদেবী পিকুর বাবা-মা। ওদের বাড়ির একতলাতেই ভাড়া থাকেন সামন্তমশাই। জগা দেশে গিয়েছে বলে ক’দিন দু’বেলা খাওয়াও সারছেন ওখানে।
পিকু ওঁদেরই ছেলে। গড়পার বয়েজের ক্লাস সিক্সের ছাত্র। সকালে অনেক ঘুরেছেন বলে সুভদ্রবাবুরা ডাকবাংলোয় বসে বিশ্রাম করছেন। এক জনের হাতে ‘আরও এক ডজন’, আর এক জনের হাতে খেরোর খাতা। পিকু সামন্তমশায়ের সঙ্গে বেরিয়েছে। সন্ধেবেলা এক চক্কর হেঁটে না এলে সামন্তমশায়ের রাতে ঘুম হয় না। আর পিকু তো বেড়াতে পেলে আর কিছু চায় না।
যেই না ধলুদের বাড়ির সামনে এসেছেন তাঁরা অমনি শুনতে পান কারা যেন ‘রে রে’ করে কাকে তেড়ে যাচ্ছে।
ব্যাপার কী জানার জন্যে বাগানের গেট পেরিয়ে ভেতরে পা বাড়ান সামন্তমশাই আর পিকু। তখনই দৃশ্যটা চোখে পড়ে দু’জনের। একটা ঝোপের ওপর সশস্ত্র হামলার উদ্যোগ চলছে। আত্মগোপন করে আছে যে জীবটি, তাকে চোখে দেখা যাচ্ছে না। আক্রমণকারীদের মধ্যে রয়েছে এলোকেশী, তার হাতে ঝাঁটা, কালুর হাতে গুলতি, ধলু নিয়েছে আধখানা বাঁশ। ওদের বাগান দেখাশোনা করে জংলি নাম যে ছেলেটির সে নিয়েছে একটা দা আর ওদের বাবা শিবেশ্বরবাবু বাগিয়ে ধরেছেন একটা মুগুর।
শুধু অস্ত্র দিয়ে আক্রমণ নয়, সামন্তমশাই শুনতে পান সমানে বাক্যবাণে বিদ্ধ করছে সবাই বাঁদরটিকে। কেউ বলছে হতচ্ছাড়া, কেউ পাজির পা-ঝাড়া, এক জন বলছে কুমড়োপটাশ আর এক জন হিপোপটেমাস।
এমন সময় দাওয়া থেকে ধলুদের মা হাঁক দেন, খালি ভালমন্দ করে কী হবে, ওকে পিটিয়ে লম্বা করে দে তবে না বুঝি। এমন মার দে যেন পালাতে না পায়। বসে বসে হাঁপায়।
এ কথা বলা মাত্র সবাই লাঠিসোঁটা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে ঝোপের ওপর। কিছুক্ষণ এলোপাথাড়ি মার দেওয়ার পর যখন তারা আশা করছে এ বার মিউ মিউ করে বেরিয়ে আসবে বাঁদরচন্দ্র, এমন সময় ঝোপের ভেতর থেকে হাঁক শোনা যায় হালুম!
সে হুঙ্কার শোনামাত্র ধলুর মা একটু আগে যে ঘরে সন্ধেবাতি জ্বালিয়েছিল, তা দপ করে যায় নিভে। ধলুর ঠাকুমা দু’দিন আগে যে দাঁত বাঁধিয়েছিলেন, তাঁর সে বত্রিশপাটি মুখ থেকে ছিটকে মাটিতে পড়ে আওয়াজ হয় ঠক! কাছের শালগাছের মাথায় এক ঝাঁক টিয়া যে তর্ক জুড়েছিল মানুষরা ভাল না মন্দ, তারা ডানা ঝটপটিয়ে কোথায় উড়ে যায় কেউ জানতে পারে না।
বাঁদর নয় বাঘ একটা। প্রমাণ সাইজ নয় অবশ্য জুনিয়র এডিশন। শিবেশ্বরবাবু টর্চ জ্বালতে সবাই চোখ বড় বড় করে দেখে তাকে। অবশ্য বাঘ বলে তাকে চেনা দায় তখন। অত জনের মার বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা তার তখন। ইতিমধ্যে পাড়ার দু’চার জন সেখানে জড় হয়েছিল, তাদের মধ্যে ব্লক অফিসের কেরানিবাবু ছিলেন। তিনি বলেন, ওরে এটাকে এখুনি হাসপাতালে পাঠা। বাঘের সংখ্যা এখন দিন দিন কমে যাচ্ছে। এর ভালমন্দ কিছু হয়ে গেলে সবাইকে জবাবদিহি করতে হবে।
তখনই ফোন করে হাসপাতালের গাড়ি আনানো হয়। স্ট্রেচার বার করে বাঘচন্দ্রকে চ্যাংদোলা করে তোলা হয় তাতে। গাড়িতে ওঠার আগে শ্রীমান বাঘ পিকুর দিকে তাকায় চোখ পিট-পিট করে। বোধ হয় তার ডোরাকাটা শার্টের নকশাটা পছন্দ হয়েছিল তার। পিকুর মনে হয় বাঘের বাচ্চা তাকে বোধ হয় কিছু বলতে চায়। সে মাথাটা নিচু করতে বাঘ তার কানে কানে বলে, আমার বাপ-ঠাকুরদারা জনা কয় বাংলা বলিয়ে-কইয়েকে ‘ইয়ে’ করে পেটের জ্বালা মিটিয়েছিল। তাই ও ভাষা আমার একটু-আধটু জানা। আজ একটা নতুন বাংলা শব্দের মানে জানলাম। মানে হাড়ে হাড়ে...
পিকু বলে ‘সেটা কী? আমি জানতে চাই।’
বাঘ জবাব দেয়, ‘গণ ধোলাই।’
বাঘকে নিয়ে হাসপাতালের গাড়ি চলে গেল গ্রামের পথ ধরে। সে দিকে তাকিয়ে পিকুর মনে হল বাংলা অভিধান থেকে এখনই কতকগুলি শব্দ বাদ দেওয়া উচিত।

ছবি: দেবাশীষ দেব


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.