শিকাগো শহরে গত সপ্তাহে কয়েক দিন একটি শব্দ বারংবার বিভিন্ন স্বরে, সুরে, বিভিন্ন মঞ্চে ধ্বনিত হইয়াছে ‘শান্তি’। শান্তির সম্ভাবনা লইয়া রুদ্ধদ্বার বৈঠকে আলোচনায় বসিয়াছিলেন ইউরোপ ও আমেরিকার শীর্ষ নেতারা। সেই একই সময়ে, রাস্তায় নামিয়া প্রতিবাদের ঢল বহাইয়া দেন শান্তির দাবিতে উদ্বেল কয়েক হাজার সাধারণ মার্কিন মানুষ। লক্ষ্য যদি শান্তি হয়, উপলক্ষ বোঝা কঠিন নহে: শিকাগো শহরে অনুষ্ঠিত হইয়াছে নর্থ আটলান্টিক ট্রিটি অর্গানাইজেশনের বা নেটো-র পঁচিশতম বৈঠক। বিশেষ বৈঠকটির আগাপাশতলা জুড়িয়া ছিল আফগানিস্তানের নেটো-পরিচালিত অভিযান। আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই ও মার্কিন প্রেসিডেন্ট ওবামা সম্প্রতি এ বিষয়ে যে বোঝাপড়ায় আসিয়াছেন, তাহারই ভিত্তিতে আলোচনা চলিল। সিদ্ধান্ত হইল, ২০১৪ সালে নেটো-বাহিনীর অপসারণ ঘটিবে, যদিও তাহার পরও ‘পৃথক লক্ষ্যে’ আফগানিস্তানে পশ্চিমি শক্তি থাকিবে, কিন্তু তাহার মুখ্য কাজ হইবে আফগানিস্তানের পুনর্নির্মাণ। আলোচনায় জোর দেওয়া হয় আর একটি বিষয়েও। ২০১৪ হইতে ২০২৪ অবধি আফগানিস্তানে পশ্চিমি দেশগুলির যে উপস্থিতি থাকিবে, তাহা কিন্তু মূলত আফগানিস্তান সরকারের নির্বন্ধেই, আন্তর্জাতিক অভিযান হিসাবে নহে। এই বক্তব্যের বার্তা পরিষ্কার। পুনর্নির্মাণের কাজটি হইবে আফগান রাষ্ট্রের অনুরোধ রক্ষার দায় হিসাবে, যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশটিকে যত শীঘ্র সম্ভব আত্মনির্ভর হইতে হইবে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংস্কারকর্মের জন্য।
শিকাগোর রাস্তায় যে শান্তির দাবি শোনা গিয়াছে, তাহা অবশ্য একটি বার্তা আনে। যতই ২০১৪ বা ২০২৪ জাতীয় সময়তারিখ শ্রুত হউক না কেন, উপর্যুপরি দুইটি যুদ্ধে মানসিক ও আর্থ-সামাজিক ভাবে ধ্বস্ত মার্কিন জনসাধারণ কিন্তু আর কোনও প্রতিশ্রুতি শুনিতে আগ্রহী নহেন, তাঁহারা সেনা-প্রত্যাহারের কাজটি দেখিতে চাহেন। প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট জর্জ ডব্লিউ বুশ সরিয়া যাওয়ার পর নূতন করিয়া ‘সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে যুদ্ধ’ নামক বস্তুটি যে ভাবে ব্যাখ্যাত হইয়াছিল, যে ভাবে ইরাক হইতে আফগানিস্তানে দৃষ্টি সরাইয়া নূতন করিয়া হাজার হাজার মার্কিন সেনা তালিবান-যুদ্ধে পাঠানো হইয়াছিল, এবং চার বছর ধরিয়া সেই অভিযান যে ভাবে ব্যর্থ, লক্ষ্যভ্রষ্ট প্রমাণিত, তাহাতে প্রতিশ্রুতি-পালনের জন্য অপেক্ষা করিতে বলা তাঁহাদের উপর জবরদস্তির সমান। বিশেষত আরও এক বার প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সামনে দাঁড়াইয়া তাঁহাদের এই অধৈর্যের প্রকাশ খুবই উল্লেখযোগ্য। মার্কিন ও ইউরোপীয় বিদেশ নীতির নৈতিক সারহীনতার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণই ছিল এই প্রতিবাদের মূল লক্ষ্য।
নেটো তথা মার্কিন প্রশাসনের বৈদেশিক দর্শনের দৈন্য পরিস্ফুট হয় বৈঠক পরিচালনার মধ্যেও। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন নাকি বৈঠক চলাকালীনই চুপিসাড়ে বাহির হইয়া শহর ঘুরিয়া দেখিতে ব্যস্ত ছিলেন। বিস্ময়কর ছিল পাকিস্তানের প্রতি নেটো-কর্তাদের ব্যবহারও। আফগানিস্তানের সহিত যে কোনও আদানপ্রদানে পাকিস্তান অতি গুরুত্বপূর্ণ, অথচ ইসলামাবাদকে আমন্ত্রণ জানানো হয় একেবারে শেষ প্রহরে। এমনিতেই বিন-লাদেন সংহার অভিযানের পর হইতে নেটো ও পাকিস্তানের সম্পর্ক মন্দ, তাহার উপর এই অপ্রয়োজনীয় সংঘাত। এই বিশৃঙ্খলা ও অদূরদৃষ্টি সত্যই উদ্বেগজনক। সমস্যাটি এমনিতেই জটিল, কোনও সমাধানের দিকে যদি সত্যই সংহত ভাবে অগ্রসর হইতে হয়, তবে কেবল মার্কিন প্রেসিডেন্ট বদল ও প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ভিত্তিতে বিশ্বনীতি পাল্টানোই যথেষ্ট নহে, একটি সার্বিক কূটনীতি-দর্শনও জরুরি। তাহার ইঙ্গিত এই পঁচিশতম বৈঠকে মেলে নাই। রাস্তার প্রতিবাদ-আন্দোলন লাঠিচার্জ দিয়া সহজেই আটকানো যায়, আফগানিস্তানে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ এত সহজসাধ্য নহে। |