তিনশো দলিতকে হত্যার অভিযোগ ছিল যাঁর বিরুদ্ধে, রণবীর সেনার প্রধান, সেই ব্রহ্মেশ্বর মুখিয়াকে তাঁর নিজের এলাকাতে গুলি করে মারল ছয় দুষ্কৃতী।
এক সময় ‘বিহারের ত্রাস’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন এই ব্রহ্মেশ্বর এবং তাঁর সশস্ত্র বাহিনী রণবীর সেনা। নব্বইয়ের দশকের সংবাদমাধ্যম শাসন করেছে গণহত্যার খবর। বাথানি টোলা, লক্ষ্মণপুর, জেহানাবাদ, নারায়ণপুর... মহিলা-শিশু সহ একের পর এক দলিত পরিবার নিকেশ হয়ে গিয়েছে রণবীর সেনার হাতে। তারা নিজেরা গণহত্যার দায় নিত। বলত, “শিশুদের মেরেছি, কারণ ওরা বড় হলে নকশাল হবে। মেয়েদের মেরেছি, কারণ ওরা নকশাল জন্ম দেবে।”
জমি দখল আর জাতপাতের লড়াইয়ের ভিত্তিভূমি থেকেই নয়ের দশকে উচ্চবর্ণীয় ভূমিহারদের নিজস্ব বাহিনী রণবীর সেনার উত্থান। সে সময় উচ্চবর্ণের কাছ থেকে জমি দখলের আন্দোলনে পিছড়ে-বর্গ এবং দলিতরা সংগঠিত হচ্ছিলেন। ‘দলিত সেনা’, ‘কুর্মি সেনা’র মতো বেশ কিছু সশস্ত্র গোষ্ঠী গড়ে উঠছিল। প্রভাব বাড়ছিল নকশালপন্থীদেরও। পাল্টা জবাব দিতে কোমর বাঁধছিলেন উচ্চবর্ণের মুখিয়ারাও। ভূমিহারদের একাধিক বাহিনী মিলেমিশেই রণবীর সেনার জন্ম ১৯৯৪ সালে। শেওনারায়ণ চৌধুরির হাত থেকে রণবীর কিষাণ সংঘর্ষ সমিতির দায়িত্ব হাতে নিয়ে তাকে দলিতদের বিরুদ্ধে রীতিমতো একটা ‘জঙ্গি বাহিনী’ হিসেবে গড়ে তোলেন ভোজপুরের খোপিরা গ্রামে অন্তত একশো বিঘা জমির মালিক ব্রহ্মেশ্বর। ১৯৯৫ সালেই নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয় ‘রণবীর সেনা’কে। ব্রহ্মেশ্বরের মাথার দাম তখনই পাঁচ লাখ। তবে সেনা তথা ব্রহ্মেশ্বরের প্রতাপ যে কমেনি, সেটা তার পরবর্তী গণহত্যার ঘটনাগুলোতেই স্পষ্ট।
২০০২ সালে গ্রেফতার হয়েছিলেন ব্রহ্মেশ্বর ওরফে ‘মুখিয়াজি’। গোপন ডেরা থেকে তাঁকে ধরার পর তাঁর ‘নিরীহ স্কুলশিক্ষকের মতো চেহারা’ দেখে অবাক হয়ে গিয়েছিল পুলিশও। আত্মপক্ষ সমর্থনে তিনি তখন বলেছিলেন, ‘‘রণবীর সেনা আগ বাড়িয়ে কাউকে মারেনি। শুধু বদলা নিয়েছে।” যাবজ্জীবন দণ্ডপ্রাপ্ত ব্রহ্মেশ্বর প্রায় ন’বছর জেল খাটার পরে গত বছর জুলাই মাসেই মুক্তি পেয়েছিলেন। তাঁর বিরুদ্ধে ২২টি মামলার ১৬টিতে প্রমাণাভাবে তাঁকে মুক্তি দেয় পটনা হাইকোর্ট। ব্রহ্মেশ্বর তখন বলেন, “আমাকে কি খুনির মতো দেখতে! আমি নির্দোষ। গণহত্যার সঙ্গে আমার কোনও সম্পর্কই নেই।”
পুলিশ সূত্রে খবর, অন্য দিনের মতো আজও ভোজপুরের নওয়াদা থানার কাতিরা এলাকায় প্রাতঃভ্রমণে বেরিয়েছিলেন ব্রহ্মেশ্বর। ভোর পৌনে পাঁচটা নাগাদ তাঁকে ঘিরে ধরে এলোপাথাড়ি গুলি চালায় মোটরবাইকে করে আসা জনা ছয়েক দুষ্কৃতী। ঘটনাস্থলেই মৃত্যু হয় তাঁর। খবর যায় রণবীর সেনার প্রধানের সমর্থকদের কাছে। মৃতদেহ আটকে রেখে ক্ষিপ্ত জনতা একের পর এক সরকারি সম্পত্তি ও গাড়িতে আগুন লাগায়। আগুন লাগানো হয় জেলাশাসকের কার্যালয়, বিডিও কার্যালয় এবং সার্কিট হাউসে। আরা স্টেশনে রেল অবরোধ হয়। নিগৃহীত হন রাজ্য পুলিশের ডিজি এবং স্থানীয় দুই বাহুবলী বিধায়ক সুনীল পাণ্ডে ও সঞ্জয় সিংহ টাইগার। আরায় কার্ফু জারি হয়। পরে কার্ফু তোলা হলেও ১৪৪ ধারা রয়েছে। |
রণবীর সেনার প্রাক্তন প্রধানের দেহ। ছবি: পিটিআই |
গত ভোটের প্রচারে মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার দাবি করেছিলেন, তিনি ক্ষমতায় আসার পরে বিহার থেকে জাতের ভিত্তিতে খুনোখুনি লুপ্ত হয়ে গিয়েছে। এখন খোদ ‘সেনা’-প্রধানই প্রকাশ্যে খুন হয়ে যাওয়ায় আইনশৃঙ্খলা নিয়ে কিছুটা হলেও প্রশ্ন তোলার সুযোগ পাচ্ছেন বিরোধীরা। আবার, এই ঘটনার অভিঘাতে আবার নতুন করে জাতভিত্তিক সংঘর্ষ শুরু হয়ে যাবে কি না, সেটাও ভাবাচ্ছে প্রশাসনকে। রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি খতিয়ে দেখতে আগামিকাল কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রসচিব রাজকুমার সিংহকে পাঠাচ্ছে কেন্দ্র। আরজেডি প্রধান লালু প্রসাদ ব্রহ্মেশ্বর হত্যার সিবিআই তদন্ত দাবি করে বলেছেন, “রাজ্যে আইনশৃঙ্খলা বলে কিছু নেই। এ দিনের ঘটনায় ফের তা প্রমাণ হল।”
কিন্তু কারা মারল মধ্য ষাট-পেরোনো ব্রহ্মেশ্বরকে? কেনই বা মারল? পুলিশের একাংশের দাবি, ব্রহ্মেশ্বর সম্প্রতি মূলস্রোতের রাজনীতিতে যোগ দিতে চেয়েছিলেন। এর ফলে বর্তমান রণবীর সেনার নেতাদের মধ্যে অনেকেই তাঁর শত্রু হয়ে গিয়েছিলেন। আর একটা মত হল, ব্রহ্মেশ্বর বেঁচে থাকলে ভোজপুরের ভূমিহারদের নতুন নেতৃত্ব উঠে আসতে পারছিল না। সেনা-সমর্থকরা অবশ্য এর পিছনে সিপিআইএমএল-এর হাত দেখছেন। এ বছর এপ্রিলেই বাথানি টোলা হত্যা মামলায় প্রমাণাভাবে খালাস পান ব্রহ্মেশ্বর। এর পুনর্বিচারের দাবিতে সম্প্রতি ধর্নায় বসে সিপিআইএমএল। রাজ্য সরকারও সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। তার আগেই খুন হয়ে গেলেন ব্রহ্মেশ্বর মুখিয়া। |