শিশু-কিশোরদের উপর যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে একটি গুরুত্বপূর্ণ আইন পাশ করিল সংসদ। আইনটি অনেকগুলি সমস্যার স্বীকৃতি দিয়াছে, সমাধানের পথও দেখাইয়াছে। প্রশাসন এবং আইনি ব্যবস্থাকে যে শিশুর প্রয়োজন এবং অধিকার সম্পর্কে অবহিত হইতে হইবে, প্রাপ্তবয়স্কদের সহিত শিশু-কিশোরদের এক দৃষ্টিতে দেখা চলিবে না, সেই জরুরি কথাটি প্রতিষ্ঠা করিল এই আইনটি। ইতিপূর্বে কোনও কোনও রাজ্য শিশুদের উপর অপরাধের প্রতিকার করিবার পদ্ধতিটি শিশুর প্রতি সহনশীল করিবার প্রযত্ন লইয়াছে। যেমন গোয়াতে শিশু যৌন নির্যাতন প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে শিশু অধিকার আইন প্রণয়ন করা হইয়াছে। দিল্লিতে বালিকা ও মহিলাদের সহায়তার জন্য ‘ক্রাইসিস ইন্টারভেনশন সেল’ বা সংকট মোকাবিলা কেন্দ্র খোলা হইয়াছে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ-সহ অন্য অনেক রাজ্যেই শিশু-কিশোরদের প্রতি বিশেষ মনোযোগী হইবার কোনও তাগিদ পুলিশ-প্রশাসনে দেখা যায় নাই। এই আইনটি দেশের সকল প্রান্তে নির্যাতিত শিশুদের সহায়তা এবং পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করিতে অত্যন্ত উপযোগী হইতে পারে, সন্দেহ নাই। সর্বোপরি, অন্যায়ের প্রতিকার পাইবার যে ব্যবস্থা, সেই তদন্ত এবং বিচার পদ্ধতিকে একটি শিশুর নিকট আরও যন্ত্রণাময়, আরও দুর্বিষহ করিয়া তুলিবার প্রথা এইবার বন্ধ হইবে, আশা করা যায়। আইন নির্দেশ দিয়াছে, শিশুকে বারবার সাক্ষ্য দিতে তলব করা চলিবে না, এবং অভিযোগের এক বৎসরের মধ্যে বিচার শেষ করিতে হইবে। ইহা বস্তুত একটি শিশুকে তাহার শৈশব উপহার দিবার সমান। তিন বৎসরের যে শিশুটি ধর্ষিত হইয়াছিল, পাঁচ-সাত বৎসর বয়সেও তাহাকে সাক্ষ্য দিতে হইতেছে, এমন অমানবিক দৃষ্টান্ত রহিয়াছে। ইহা যেমন যুক্তিবিরোধী, তেমনই নীতিবিরোধী। বিচারের নামে এই অর্থহীন নিষ্ঠুরতা বন্ধ করিতে এই আইনের প্রয়োজন ছিল।
কিন্তু যে কোনও আইন প্রয়োগেরই একটি বৃহত্তর প্রেক্ষিত থাকে। এই আইন অনুসারে, ১৮ বৎসরের কম বয়সীদের ক্ষেত্রে যৌন সম্পর্কে শিশু, বালিকা বা কিশোরের সম্মতি ছিল কি না তাহা গ্রাহ্য করা হইবে না। ভারতের ফৌজদারি আইনে যদিও ১৬ বৎসরকে সম্মতি দিবার যোগ্য বলিয়া স্বীকার করা হইয়াছে, এই আইন তাহা মানে নাই। ফলে স্বভাবতই প্রশ্ন উঠিবে, যে দেশে এখনও ১৮ বৎসরের পূর্বে বিপুল সংখ্যায় বালিকাদের বিবাহ হইয়া যায়, সেখানে এই আইনের ফলে কী ধরনের জটিলতার সৃষ্টি হইবে। বালিকার বা তাহার অভিভাবকদের সম্মতির কোনও মূল্য যদি আইনের চোখে না থাকে, তাহা হইলে কেবল বিবাহ অসিদ্ধই হয় না, ধর্ষণের দায়ে স্বামীটিও অন্তত সাত বৎসরের জন্য কারাগারে ঢুকিতে পারে। বধূকেও যে কোনও নির্যাতিত বালিকার ন্যায় সরকারি হোমে রাখিতে হইতে পারে। বস্তুত এই ধরনের ঘটনা যে অহরহ ঘটিতেছে, তাহার বহু নিদর্শন মিলিবে। অতএব এমন আইন কি সমর্থনযোগ্য? ইহার দ্বিধাহীন উত্তর, হ্যাঁ। আইন অনুসারে বালিকা বিবাহ বরাবরই অপরাধ, তাহার প্রতি সহনশীল হইয়া নূতন আইন প্রণয়ন করা উচিত নহে, সম্ভবও নহে। প্রয়োজন এই আইনটির ব্যাপক প্রচার, যাহাতে কন্যাদায়গ্রস্ত পিতা হইতে পলায়নেচ্ছু প্রেমিক-প্রেমিকা, সকলেই অবগত হয় যে তাহারা অপরাধী এবং শাস্তিযোগ্য। আইন যত সরল, শর্তহীন, জটিলতাহীন হইবে, তাহার প্রচার এবং পালনও তত সহজ হইবে। |