কবির মেলা জাগে মাঝরাতে।
কবি নেই। তাঁর স্মৃতি রয়েছে। আর রয়েছে চুরুলিয়ার বাস্তুভিটে।
কবির জন্ম নিদাঘ দিনে। জ্যৈষ্ঠের খর রোদে জ্বলতে থাকে খনি, মাঠঘাট। জানলা খুললে ঝাঁপিয়ে আসে হলকা।
মেলা তাই চুপটি করে অপেক্ষায় থাকে রাতের। রানিগঞ্জ-জামুড়িয়ার খনির আকাশ তামাটে করে পশ্চিমে গড়িয়ে যায় আগুনের বল। তারও বেশ কিছুটা পরে পায়ে পায়ে চলা শুরু হয় মেলার দিকে।
শুক্রবার, ১১ জ্যৈষ্ঠ রাত ঘনাতেও সেই চলা ফের শুরু হয়েছে। বর্ধমানের জামুড়িয়ায় নজরুল ইসলামের নিজের গ্রাম চুরুলিয়ায়।
রাত একটু বাড়তে চুরুলিয়া থেকে চার কিলোমিটার দূরে মদনতোড় গ্রাম থেকে সপরিবার বেরিয়ে পড়েছিলেন প্রবোধ ঘাঁটি। পাশের সত্তর গ্রাম থেকে রওনা দিয়েছিলেন শ্রাবণী মণ্ডল। পনেরো কিলোমিটার দূরে ইকড়া থেকে বেরিয়ে পড়েছিলেন বাবন বাগদি। কাছেই জয়নগর থেকে তুলসী ঘোষ।
যাঁরা নিতে নয় দিতে এসেছেন, সেই দোকানিরা অবশ্য ঝাঁপ তুলেছিলেন সন্ধ্যা নামতেই। এলাকার ব্যাপারীরা তো বটেই, দূর-দূরান্তের ভাগ্যান্বেষীরাও হাজির। গত পনেরো বছর ধরে হরেক খাবার নিয়ে মেলায় আসছেন গুসকরার দুলাল দেবনাথ। মোগলাই পরোটা যেমন বানাচ্ছেন, বিক্রি করছেন গজাও। “সবেরই দেদার বিক্রি” হাসিমুখে বলেন তিনি। পুরুলিয়ার নিতুড়িয়ায় সরবড়ি গ্রাম থেকে মেয়েদের জন্য মনোহারি গয়না নিয়ে এসেছেন মহম্মদ মোক্তার। এ রকম আরও কত জন! |
১৯৭৮ সাল থেকে মেলা বসছে চুরুলিয়ার নজরুল অ্যাকাডেমি সামনেই। অ্যাকাডেমির সম্পাদক মোতাহার হোসেন বলেন, “এত রোদে দিনে কে মেলায় আসবে? তাই সাত দিন ধরে রাতেই মেলা বসানো হয়।” অ্যাকাডেমির সামনে বসেই হাতে তৈরি পোশাক বিক্রি করছিলেন শিপ্রা মিদ্দা, আনিসুল আলমরা। তাঁরা বলেন, “সারারাত ধরে কেনাকাটা চলে। ভোর হলে তবে শেষ। এখানে যাঁরা আসেন, মেলার এই অন্য রকম রীতিতে তাঁরাও অভ্যস্ত।”
রাত গভীরে দেখা গেল কাঁধে-কোলে দুই আধ-ঘুমন্ত ছেলেকে নিয়ে ঘুরছেন জামুড়িয়ার বালানপুর থেকে আসা সুবল সিংহ ও তাঁর স্ত্রী। সুবলবাবু বললেন, “ঘুমিয়ে পড়ার আগে পর্যন্ত বাচ্চারা দারুণ মজা করেছে। আমরা অনেক দিন ধরেই ভেবেছি, এই মেলায় আসব। কিন্তু যানবাহনের সমস্যার জন্য সেটা হয়ে ওঠেনি। দেখি, কিছু পাই কি না!”
কিন্তু রাতে যানবাহন পাওয়া শক্ত। মদনতোড়ের প্রবোধবাবুর মতো যাঁরা গাড়ি নিয়ে এসেছেন তাঁদের তবু নিজের মর্জি চলে। চাইলে ফিরেও যেতে পারেন মাঝরাতে। কিন্তু বাকিদের মেলায় ঢুকে পড়তে হয় গাড়িঘোড়া বন্ধ হওয়ার আগেই। ভোরে ফের সব চালু হলে তবে ফেরা। ইকড়ার বাবন বাগদির মতো অনেকে আবার এসেছেন দল বেঁধে গাড়ি ভাড়া করে। তাঁর কথায়, “প্রতিবারই আমরা গাড়ি ভাড়া করে রাতে মেলায় আসি। সাত দিনে এক দিন তো বটেই!” জামুড়িয়ার ধনঞ্জয় পাঠক আবার বন্ধুদের সঙ্গে আসেন মোটরবাইকে। গ্রামে যাঁদের আত্মীয়-স্বজন আছেন, তাঁরা সেখানেই ঘাঁটি গাড়েন। আখতার ইসলামের বাড়ি যেমন এখন আত্মীয়-বন্ধুতে গমগম করছে।
কাচের চুড়ি, নাগরদোলা, বাসনকোসনের পাশাপাশি মেলার অন্যতম আকর্ষণ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানও। এ বার যেমন বাংলাদেশের বুলবুল ললিতকলা অ্যাকাডেমির ১৬ জন শিল্পী থাকছেন, আসছেন কবির নাতি গিটার-শিল্পী অরিন্দম কাজি এবং খিলখিল কাজিও। পঞ্জাবিতে নজরুল গীতি গাইবেন চণ্ডীগড়ের সঙ্গীতা চৌধুরী। অহমিয়া ভাষাতেও গাওয়া হবে কবির গান। সেই সঙ্গে বিহু।
চুরুলিয়া কিন্তু একা নয়। নজরুলের মামার বাড়ি জামুড়িয়ার যে ভুরি গ্রামে, সেখান থেকে কিলোমিটার তিনেক দূরে ছত্রিশ গণ্ডা গ্রামেও একই ভাবে সাত দিন রাত জাগে মেলা।
শনিবার ভোর হয়। খুশি মুখে বাড়ির পথ ধরে ক্লান্ত পা।
আবার হয়তো ফিরবে রাত হলেই... |