ব্যাগ গুছিয়ে...
দামালের দলমায়
দিবাসীদের গ্রাম আর পলাশের জঙ্গলটা পেরনোর সঙ্গেই শালফুলের গন্ধে মনটা মেতে উঠল। একটু এগিয়ে পাহাড় ছুঁতেই মহুয়ার গন্ধের সঙ্গে ভেসে উঠল রাজেনদার মুখটা। আমাদের পাড়ার কবিতাপ্রেমী রাজেনদা। বলেছিল, ফেরার সময় মহুয়া নিয়ে আসিস কিছুটা আর শোনাস সেই দলমার গল্প।
‘গল্প’? এখানে কোনও গল্প হয় না। সবটাই বাস্তব। ১১৯৩ বর্গকিলোমিটার জুড়ে পাহাড় ঘিরে সবার বেঁচে থাকার লড়াই। একা দলমা রেঞ্জ অফুরন্ত রসদ জুগিয়ে যাচ্ছে মানুষ ও জীবজন্তুদের। শীতে তার এক রূপ, বর্ষায় উথলে ওঠে যৌবন, বসন্তে সে সবচেয়ে রোম্যান্টিক আর গ্রীষ্মে সে প্রতি মুহূর্তে চ্যালেঞ্জ জানাচ্ছে। সে সময় ভয় আর কষ্টকে জয় করতে পারলে এটি ভারতের সেরা পাহাড়ি অরণ্য।
এ সময় এখানে এলে দামাল মহাকালের (হাতি) সঙ্গে দিনরাত ঘর করার ‘সৌভাগ্য’ হবে। উপলব্ধি করা যায় আদিবাসীদের না-পাওয়া ভরা জীবন। বাঁকুড়া, মেদিনীপুর, বীরভূমের বাসিন্দাদের রাতের ঘুম আর খেতের মিষ্টি পাকা ধানে থাবা মেরে নিরাপদ দলমার আশ্রয়ে ফিরে আসা বুনো হাতিদের রমরমা এই গরমেই।
পাহাড়ের পায়ে মাকুলাকোছা ফরেস্ট রেস্ট হাউসে ট্যুরিস্টদের থাকার ব্যবস্থা থাকলেও পাহাড়ের একদম মাথায় পিন্ডাবেরায় থাকার অ্যাডভেঞ্চারই আলাদা, যদিও সেটা পেতে কাঠ-খড় পোড়াতে হয় যথেষ্ট। চাকুলিয়া চেকানাকায় (চেকপোস্ট) যাবতীয় কাগজপত্র দাখিল করে, অরণ্যে ঢোকার অনুমতি নিয়ে যখন গাড়ি স্টার্ট দিল তখনই বিরল প্রজাতির এক বাজপাখি তীব্র চিৎকারে উড়তে উড়তে সামনের পিয়াল গাছের মাথায় বসে ছবি তোলার পোজ দিল। জঙ্গলগার্ড পরিষ্কার বার্তা দিলেন, ‘পথে হাতি পড়লে গাড়ি দাঁড় করাবেন, কিন্তু স্টার্ট বন্ধ করবেন না, ওরা সরে গেলে তবেই যাবেন। মনে রাখবেন আপনারা ওদের অতিথি।’ মাকুলাকোছা গ্রাম-সংলগ্ন প্রায় ১৫ কিমি এলাকা বিদ্যুৎবাহী তার দিয়ে ঘিরে রাখা হয়েছে হাতিদের আটকানোর জন্য, তার পরে তাদের মুক্তাঞ্চল।
বেলা প্রায় দশটা। বর্ণময় জঙ্গলের পথে ঘন শাল, করঞ্জা, অমলতাসেরা সূর্যকে ঢেকে রাখার অক্লান্ত চেষ্টা চালাচ্ছে। একটু আগের প্রচণ্ড তাপ আস্তে আস্তে মিলিয়ে যাচ্ছে। গাড়ির চাকায় শুধু চড়চড় আওয়াজ, গুঁড়ো হয়ে যাচ্ছে শুকনো পাতাগুলো।
‘মড়াৎ’! হঠাৎ আওয়াজে সবাই বাকরুদ্ধ! পথ অবরুদ্ধ নয়, তবুও কে এগোবে? রাস্তার ধার ঘেঁষে খাদের একদম কিনারায় মা হাতি তার বাচ্চাকে ধুলো মাখাচ্ছে। বাবা ডাল ভেঙে খাচ্ছে অবিরত। খাবার সে কি আয়োজন। দীর্ঘ অপেক্ষার পরে চল টমটম, গিয়ার চেঞ্জ করে গতি চড়িয়ে ওদের পাশ কাটিয়ে লাফাতে লাফাতে এক ছুটে পিন্ডাবেরায়।
পিন্ডাবেরার ফরেস্ট বাংলোর ব্যালকনিতে দাঁড়ালেই বিস্ময়! একদম বন্য অরণ্যের ঢাল গড়িয়ে প্রায় হাজার দুয়েক ফুট নীচে নেমে গিয়ে মিশেছে জাতীয় সড়কের ধারে আসানবনির হোটেলগুলোর গায়ে।
এখানে পাহাড় আর সবুজে চোখ জুড়োয়, মন হারায় ময়ূর আর নানা পাখির কাকলিতে। ‘রাতে এখানে অন্য ম্যাজিক দেখা যায় দাদা,’ ছাদের ট্যাঙ্কে কতটা জল আছে দেখতে দেখতে বনকর্মী গিরিদা মন্তব্য করেন। সতর্ক করলেন, ‘দয়া করে জল খুব কম খরচ করবেন, নীচের ইঁদারার জলও শুকিয়ে আসছে।’
দূরে নীচের খোলা রসুইঘরে তখন গনগনে কাঠের জালে মুরগির ঝোল চড়েছে, গন্ধে চার পাশ ম-ম। কাঠের জালের অফুরন্ত যোগান এখানে। অরণ্য প্রকৃতির মাঝে পাথুরে ইঁদারার জলে আপাদমস্তক ভিজতেই ‘উফ্’! ‘স্নান যে বিলাস’ তা আক্ষরিক অর্থেই বোঝা গেল। কিন্তু একি! ডিডো তো ঘেরাও হয়ে গেছে গরুর পালে, সবাই জল খেতে চায়। কত জল ও তুলবে? বালতি হাত থেকে নামতেই চোঁ-চো করে শেষ করে দিচ্ছে মহেশের দল। এই জঙ্গলে লোক নেই, ঘর নেই, এত গরু এল কী ভাবে? জানা গেল, সব ওপরের মন্দিরের আশ্রমের গরু। কয়েকশো গরু আছে দলমা টপে হনুমান মন্দিরের আশ্রমের। নিঝুম দুপুরটা এখানে পার হয়ে যায় জায়ান্ট স্কুইরেলের নাচ আর তাদের ভাষা শুনতে শুনতে। বাংলোর সামনে শিমুল গাছে বসে অতিথি আপ্যায়ণের পুরো দায়িত্ব ওদের নিয়মিত।
নিচলা বাঁধে বিকেলে সবাই যখন জড়ো হলাম তখন প্রায় বিকেল চারটে। এই সেই সন্ধিক্ষণ, মোটামুটি এই সময় থেকে ঐরাবত বাহিনী জড়ো হয় তাদের জলের ট্যাঙ্ক লোড করার জন্য। কিন্তু কী ব্যাপার? আমাদের গন্ধ কি ওরা পেয়ে গেল নাকি? কাউকেই দেখতে পাচ্ছি না যে। অভিজ্ঞ জঙ্গল-গাইড অনুমান করেন, আজ বোধ হয় সব মঝলা বাঁধেই ভিড়েছে। চল মঝলাবাঁধ। নিচলাবাঁধ, মঝলাবাঁধ আর বড়াবাঁধ এই গুটিকয়েক প্রাকৃতিক জলাধারেই মোটামুটি জল থাকে প্রখর গ্রীষ্মেও। তাই দলমার প্রায় সমস্ত হাতি-পরিবার জড়ো হয় এই জলাধারে। এই জলাধার ও পুকুরের পারেই পাথরের শক্তপোক্ত ঘর করা আছে নিরাপদে তাদের জলকেলি দেখার জন্য।
ওই তো! জঙ্গলের প্রায় তিনকোনা থেকে নেমে আসছে দামালের দল। এক দুই আট নয় বারো আঠারো..., ধুস চুলোয় যাক সংখ্যা, বিশ্বপ্রকৃতির এক অন্যতম বিরাট প্রজাতি কী রকম নিঃশব্দে ধুলোস্নান করছে না দেখলে বিশ্বাস হয় না। ওদের গায়ের উগ্র বুনো গন্ধটা যেন আমাদের শরীরে লেপটেলুপটে বসে যাচ্ছে এতটাই নিকট দূরত্ব তাদের সঙ্গে। আচমকা এক দাঁতাল দলপতি বুঝতে পারে আমাদের অনধিকার দর্শন। হুঙ্কার ছাড়ে। ঘোলা জলে তখন অস্তগামী সূর্যের মেটে রঙের আভা। দুধসাদা গো-বকগুলো হাতিদের জ্বালায় জলাশয় ছেড়ে গাছের মাথায়। অরণ্যে সন্ধ্যা নামে ঝুপুস করে। এই সময়ের পর থেকেই এ পথ অন্য রকম বিপজ্জনক। বাধ্য হয়েই সন্ধ্যার মধ্যেই ফরেস্ট হাউসে ফিরে আসা।
রাতে ব্যালকনিতে বসতেই আরিব্বাস! সত্যিই রাতের ম্যাজিক তো শুরু হয়ে গিয়েছে। প্রায় ১৫০ ডিগ্রি সমান্তরাল জুড়ে উপত্যকার একদম নীচের অংশে ঝিকিমিকি নানান রং-বেরঙের আলোয় সেজে উঠছে অপ্সরা জামসেদপুর। সারা উপত্যকা জুড়ে ক্ষণে-ক্ষণে রাতচরা পাখি আর ময়ূরের ছন্দোময় ডাকে ‘লাইট অ্যান্ড সাউন্ডের’ বনজ সংস্করণ। প্রাণ জুড়োনো দক্ষিণী বাতাসে তখন তীব্র মহুয়ার গন্ধ, মায়াবী অরণ্যের কী অদম্য হাতছানি, এ রাতেই না ‘হ্যাংওভার’ হয়ে যায়!
ঘুমের নেশা কেটে গেল একদম কোকিল ডাকা ভোরে। এই সময় ভালুক, সজারুরা শিকার শেষে ঘরে ফেরে। যদি দেখা যায় তা হলে হাতির ডেরায় উপরি পাওনা তো বটেই। নিশিভোরে দলমা যে কতটা রোম্যান্টিক না ঘুরলে কি বোঝা যায়? বনকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে মঝলাবাঁধ ছেড়ে কিছুটা এগোতেই, সর্বনাশ! এ দৃশ্য দেখব এ তো চিন্তার বাইরে ছিল। জঙ্গলের ধার ঘেঁষে পড়ে আছে এক বিরাট মাপের মৃত সজারু। জঙ্গলপথে পালিয়ে যাচ্ছে শিকারির দল। গাড়ি থামিয়ে ‘চেজ’ করেও চোরাশিকারিদের ধরা গেল না। পাওয়া গেল তাদের ফেলে যাওয়া গুলি-বারুদ, টর্চ, কম্বল। সরকারের নির্দিষ্ট করে দেওয়া একটা দিন ‘শিকার উৎসব’ ছাড়াও চোরাগোপ্তা শিকার আজও হয়ে চলেছে।
সবুজ শালফুলে শুয়ে থাকা সজারুর কানের পাশে ছররা-বেঁধা তীব্র যন্ত্রণার স্মৃতিটাই শেষে নিয়ে চললাম রাজেনদার জন্য!

কী ভাবে যাবেন
কলকাতা থেকে গাড়িতে জামশেদপুর থেকে মাঙ্গো হয়ে দলমা কিংবা
ট্রেনে জামশেদপুর, সেখান থেকে গাড়ি বুক করে দলমায়।
বাংলো বুকিং
মাঙ্গোতে বনদফতরের অফিস। ওখানেই বাংলো বুকিং ফরেস্ট রেঞ্জ অফিসার,
দলমা ওয়াইন্ড লাইফ স্যাংচুয়ারি, মাঙ্গো, জামসেদপুর।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.