পুরস্কার কেবল তাহার প্রাপককে সম্মানিত করে, এমন নহে। তাহা পুরস্কার দাতার সন্ধানী দৃষ্টি, উৎকর্ষের বোধ এবং উদারতার পরিচয় দিয়া তাঁহারও মর্যাদা বৃদ্ধি করে। নির্বাচন প্রক্রিয়াটির মর্যাদা এবং শোভনতা রক্ষা করা তাই দুই তরফেই প্রয়োজন। এ বৎসর বিদ্যাসাগর পুরস্কারের ক্ষেত্রে প্রাপকদের নাম লইয়া যে গোলযোগ বাধিল, তাহা দুর্ভাগ্যজনক। বাংলা অ্যাকাডেমির সভাপতি সরকারের সহিত বিবাদের জেরে পদত্যাগ করিলেন। প্রস্তাবিত প্রাপকরা অতিশয় বিব্রত হইলেন, তাহা সহজেই অনুমেয়। তাঁহাদের প্রতিভা সম্মানের যোগ্য কি না এ বিষয়ে প্রকাশ্যে মনান্তর তাঁহাদের অবমাননার সমান। সরকারও ইহাতে অপদস্থ হইল, কারণ সরকারি প্রতিষ্ঠান বাংলা অ্যাকাডেমির সহিত সরকারি ‘কেন্দ্রীয় নির্বাচক কমিটি’র মতান্তর প্রকাশ্যে আসিয়াছে। পুরস্কার নির্বাচনের প্রক্রিয়াটি নিম্নস্তরের কোন্দলে পরিণত হইয়াছে। লক্ষণীয়, মূল বিতর্কটি আদৌ প্রাপকের যোগ্যতা লইয়া নহে। ইহার মূল ক্রমাগত ক্ষমতার বৃত্ত অঙ্কনে। প্রাপক নির্বাচনের দায়িত্ব যদি বাংলা অ্যাকাডেমির হয়, তাহা হইলে তাহার উপরে আরও একটি ‘কমিটি’ তৈরি করিবার প্রয়োজন কী? যিনি বাংলা অ্যাকাডেমির সভাপতি, তাঁহার অধিক সাহিত্যবীক্ষা অপর এক বা একাধিক ব্যক্তির থাকিলে, তাঁহাদের কাহাকেও সভাপতি পদে নিয়োগ করা যাইতে পারে। কিন্তু কমিটির মতের উপর সরকারি মত চাপাইয়া দেওয়া উচিত নয়। বেআইনি না হইলেও, তাহা অনৈতিক। ক্ষমতা থাকিলেই ক্ষমতার ব্যবহার করিতে হইবে, ইহা এক বড় ভ্রান্তি। নির্বাচন প্রক্রিয়া স্বচ্ছ এবং জটিলতাহীন করিতে হইলে পুরস্কার নির্বাচনের জন্য নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া এবং প্রতিষ্ঠানকেই মানিতে হইবে।
যে কোনও পুরস্কারের যোগ্যতম প্রাপক কে, তাহা লইয়া মতান্তর অসম্ভব নহে। যাঁহারা নির্বাচনে অসন্তুষ্ট, তাঁহাদের বক্তব্যেও যথেষ্ট সার থাকিতে পারে। কিন্তু এ ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত মতামতের ঊর্ধ্বে স্থান দিতে হইবে প্রতিষ্ঠান এবং প্রাতিষ্ঠানিক বিধিকে। বাংলা অ্যাকাডেমির দ্বারা প্রাপক নির্বাচনই যদি সরকার-অনুমোদিত নিয়ম হইয়া থাকে, তাহা হইলে অ্যাকাডেমি যাহাকে নির্বাচন করিবে সেই ব্যক্তি সরকারি কর্তাব্যক্তিদের অপছন্দ হইলেও তাহাকেই যোগ্য প্রাপক বলিয়া মানিয়া লইতে হইবে। অন্যথায় গোটা প্রক্রিয়াটিই অর্থহীন হইয়া যায়। কাজটি সহজ নহে। সরকারি স্বীকৃতি লাভের জন্য নানা পক্ষ হইতে সরকারি কর্মী এবং রাজনৈতিক ব্যক্তিদের উপর নানা চাপ তৈরি হয়, তাহা বহুবিদিত। নানা প্রলোভন, আস্ফালন, আবেদন-নিবেদন নির্বাচনের প্রক্রিয়াকে গ্রাস করিতে চাহে। এই সকল বাধা যতই প্রবল হইয়া উঠুক, ইহাদের দ্বারা পুরস্কারের গৌরবহানি হইতে না দিবার দায়টিও সরকারেরই। গত এক বৎসরে সেই কঠিন কাজটি কঠিনতর হইয়া উঠিয়াছে, কারণ পুরস্কারের সংখ্যা ও প্রাপক বহুগুণ বর্ধিত হইয়াছে। সরকারি পুরস্কার এতগুলি ঘোষিত হইয়াছে, এবং তাহাদের প্রাপকও এত বৃ্দ্ধি পাইয়াছে, পুনঃপুনঃ একই ব্যক্তিকে এত বার পুরস্কৃত করা হইতেছে, যে রাজ্যবাসী হকচকাইয়া যাইতেছেন। সম্মানের ঘনঘটায় আমরা ভুলিতে বসিয়াছি, বিরলতাই পুরস্কারকে বরণীয় করিয়া তোলে। |