ঠিক দুই বৎসর পূর্বে কেন্দ্রীয় সরকার মহা সমারোহে ঘোষণা করিয়াছিল, পেট্রোলের দাম হইতে সরকারি নিয়ন্ত্রণ তুলিয়া লওয়া হইল। আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম যেমন বাড়িবে-কমিবে, ডলারের দাম যে ভাবে উঠিবে-পড়িবে, দেশের বাজারে পেট্রোলের দামও সেই ভাবেই নির্ধারিত হইবে। সিদ্ধান্তটি বহু পূর্বেই কর্তব্য ছিল, কিন্তু রাজনীতিকরা আর কবে কর্তব্যপালনে তৎপর হইয়াছেন! সিদ্ধান্তটি অসম্পূর্ণও ছিল বটে, ডিজেল-কেরোসিন-এল পি জি-র দাম হইতে নিয়ন্ত্রণ সরাইবার কথা সরকার বলে নাই। তবুও আশা জাগিয়াছিল, হয়তো সত্যই রাজনীতির হৃদয়ে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুভূত হইয়াছে। দুই বৎসর পরে আজ স্পষ্ট, সেই আশা কতখানি ভিত্তিহীন ছিল। এখনও কেন্দ্রীয় মন্ত্রিসভার অনুমতি না পাওয়া পর্যন্ত পেট্রোলের দামে এক পয়সা হেরফের করিবার উপায় নাই। আন্তর্জাতিক বাজারে অপরিশোধিত তেলের দাম আকাশ ফুঁড়িয়া ফেলুক, ডলারের দাম সমানে ঊর্ধ্বমুখী হউক কেন্দ্রীয় নেতারা ঘাড় না নাড়িলে পেট্রোলের দাম বাড়ায়, সাধ্য কাহার। গত নভেম্বরে শেষ বার পেট্রোলের দাম বাড়িয়াছিল, তাহাও আবার শরিকি চাপে খানিক কমাইয়া ফেলা হইয়াছিল। তাহার পর দাম বাড়িল গত ২৩ মে। এই মূল্যবৃদ্ধির সহিত বাজারের কোনও সম্পর্ক নাই ইহা রাজকোষের আগুন নিভাইবার অক্ষম চেষ্টামাত্র।
কলিকাতায় এক লিটার পেট্রোলের দাম দাঁড়াইল ৭৭ টাকা ৮৮ পয়সা। তেল বিপণনকারী সংস্থাগুলির নিকট এই মূল্যের অর্ধেক পৌঁছাইবে। বাকি টাকা যাইবে কেন্দ্রীয় এবং রাজ্য সরকারের রাজকোষে, বিভিন্ন বিভিন্ন শুল্ক বাবদ। আন্তর্জাতিক বাজারে যখন তেলের দাম চড়া, টাকার দাম হু হু করিয়া পড়িতেছে, তখন পেট্রোলের উপর এমন চড়া রাজস্ব আরোপ করিবার কারণ কী? কারণ সহজবোধ্য সরকারের ব্যয় আয়ের সহিত সাযুজ্যহীন, ফলে যেমন করিয়া হউক, কিছু বাড়তি রাজস্ব আদায় না করিয়া তাহার উপায় নাই। ফলে, বাজারের চাপেই যখন তেলের দাম গগনচুম্বী হওয়ার কথা, তখনও সরকার রাজস্বের বোঝা কমাইতে পারে না। এই অর্থে সরকার খয়রাতি করিয়া থাকে। ডিজেলের মূল্যে ভর্তুকি দেয়, সস্তায় সার বিলায়, কর্মসংস্থান যোজনায় প্রভূত ব্যয় করে। রাজনীতির যজ্ঞে অর্থনীতিকে আহুতি দেওয়াই ভারতের দস্তুর। উল্লেখ্য, রোগটি কেন্দ্রীয় সরকারের একচেটিয়া নহে, রাজ্যগুলিও একই রোগে আক্রান্ত। অর্থমন্ত্রীর কর্তব্য, অবিলম্বে পেট্রোলের উপর শুল্কের পরিমাণ যুক্তগ্রাহ্য স্তরে নামাইয়া আনা এবং তাহার মূল্য নিয়ন্ত্রণের প্রক্রিয়াটি বাজারের হাতে ছাড়িয়া দেওয়া।
এ ক্ষণে বৃহত্তর একটি প্রশ্ন তোলা প্রয়োজন। পেট্রোল হইতে যে রাজস্ব আদায় করা হয়, তাহার প্রায় অর্ধেক উৎপাদন শুল্ক বাবদ কেন্দ্রীয় রাজকোষে পৌঁছায়। অপরিশোধিত তেলের উপর আমদানি শুল্কের অধিকারীও কেন্দ্রীয় সরকার। স্বভাবতই, কোন শুল্কের হার কী হইবে, তাহা কেন্দ্রীয় সরকারই স্থির করে এবং সেই হার রাজ্যগুলির উপর চাপাইয়া দেয়। পরোক্ষ কর অর্থনীতির উপর কী প্রভাব ফেলে, তাহা বহু আলোচিত। স্বাভাবিক ভাবেই, কেন্দ্রীয় শুল্কের আঁচ রাজ্যগুলি এড়াইতে পারে না। যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় এমন হওয়ার কথা নহে। একটি ব্যবস্থা প্রয়োজন, যাহাতে প্রতিটি রাজ্য কেন্দ্রীয় শুল্কের বিষয়ে নিজেদের মতামত প্রকাশ করিতে পারে। শুধু তাহাই নহে, দেখিতে হইবে যাহাতে কেন্দ্রীয় সরকার রাজ্যগুলির মতামত এড়াইয়া না যাইতে পারে। শুধু পেট্রোলের ক্ষেত্রেই নহে, প্রতিটি পণ্য ও পরিষেবার ক্ষেত্রেই এই নিয়ম মানিয়া চলাই বিধেয়। আর্থিক ক্ষেত্রে ভারত এখনও এক তীব্র এককেন্দ্রিক ব্যবস্থার উত্তরাধিকার বহিয়া বেড়াইতেছে। নূতন করিয়া ভাবিবার সময় আসিয়াছে। |