সামান্য ফাঁক করা দরজাটা ঠেলে ঢুকতেই দেখা মিলল তাঁর। খাটের উপরে ল্যাপটপের স্ক্রিনে দুই খুদের সহাস্য ছবিতে তন্ময় বছর আঠাশের তরুণী। কেমন আছেন?
একটু চমকে ল্যাপটপ থেকে চোখ উঠল। ক’মুহূর্তের বিহ্বলতা। তার পরে স্ক্রিনের দিকে তাকিয়ে শান্ত উত্তর, “এই... এ ভাবেই আছি! ছবি দেখে।” খোলা ল্যাপটপে হাসছে দুই খুদে অভিজ্ঞান আর ঐশ্বর্যা ভট্টাচার্য! সে দিকে তাকিয়ে ম্লান হাসলেন মা সাগরিকা চক্রবর্তী (ভট্টাচার্য)। মাস ঘুরতে চলল, নয়াদিল্লি-নরওয়ে বিস্তর টানাপোড়েন শেষে ভারতে ফিরেছে প্রবাসী দম্পতি অনুরূপ-সাগরিকার দুই সন্তান। ফিরেও মা-বাবার কোলছাড়া। অনুরূপ এখনও ও দেশে। আর সাগরিকা দেশে থেকেও বাচ্চাদের কাছে পাচ্ছেন না। কেন?
অভিজ্ঞান-ঐশ্বর্যাকে ফিরিয়ে আনতে নরওয়ের শিশুকল্যাণ সংস্থা (বার্নেভার্নে)-র সঙ্গে ভারত সরকার ও অনুরূপ-সাগরিকার যে চুক্তি হয়েছিল, সেটাই এখন বিবাদের বিষয়। বাড়িতে ঠিকঠাক দেখভাল হচ্ছে না এই যুক্তিতে বার্নেভার্নে দুই শিশুকে হেফাজতে নিয়েছিল। পরে কাকা অরুণাভাস ভট্টাচার্যের হাতে তাদের তুলে দিতে রাজি হয়। আপাতত ভট্টাচার্য পরিবারের কুলটির বাড়িতে কাকারই তত্ত্বাবধানে রয়েছে দু’জন। ভট্টাচার্য পরিবারের দাবি, ভাইপো-ভাইঝির দেখভালের ভার অরুণাভাস অন্য কারও হাতে ছাড়তে পারেন না, কারণ তাতে চুক্তি লঙ্ঘন করা হবে। অন্য দিকে সাগরিকার প্রশ্ন, নরওয়ের চুক্তি এ দেশে খাটবে কেন? চুক্তির দোহাই দিয়ে সন্তানদের মায়ের সাহচর্য থেকে বঞ্চিত করা হচ্ছে বলে তাঁর অভিযোগ। |
গত প্রায় এক মাস যাবৎ এমনই পরিস্থিতি। নরওয়েতে প্রায় এক বছর মা-বাবার থেকে দূরে ছিল অভিজ্ঞান-ঐশ্বর্যা। যার জন্য অভিজ্ঞানের এখন ‘অ্যাটাচমেন্ট ডিসঅর্ডার’-এর চিকিৎসা চলছে। অরুণাভাস জানিয়েছেন, ঠাকুর্দা-ঠাকুমা ও পরিবারের অন্যদের সঙ্গে দু’জন ভালই আছে। যদিও কলকাতায় বাপের বাড়িতে বসে সাগরিকা জানালেন, “ওরা কুলটি যাওয়ার পরে খোঁজই পাচ্ছি না! ফোন করলেও জুটছে খারাপ ব্যবহার। আমাকে বাচ্চাদের কাছেই ঘেঁষতে দিচ্ছে না।” অবিবাহিত অরুণাভাস কী ভাবে বাচ্চাদের দেখাশোনা করছেন, তা নিয়ে বিস্মিত সাগরিকা।
দেশে এসেও বাচ্চাদের থেকে মা দূরে কেন? ভট্টাচার্য পরিবারের বক্তব্য: সাগরিকা চাইলে কুলটিতে গিয়ে থাকতেই পারেন। তবে ভবিষ্যতে বাচ্চারা কোথায় থাকবে, সে সিদ্ধান্ত অনুরূপ নেবেন। নরওয়ের চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে, বাড়ি বেচে দেনা শোধ করে অনুরূপের ফিরতে আরও তিন-চার মাস। যে প্রসঙ্গে সাগরিকার মন্তব্য, “জানি না। কথা হয় না।”
অনুরূপ-সাগরিকার ‘দাম্পত্য-সম্পর্ক’ নিয়ে প্রশ্ন অবশ্য নতুন নয়। তবে এত দিন এ নিয়ে কেউই সংবাদমাধ্যমে মুখ খোলেননি। অভিজ্ঞান-ঐশ্বর্যা ফেরার পরে ফেসবুকের ‘ওয়াল’-এ সাগরিকা শুধু লিখেছিলেন, “বাচ্চাদের ভালর জন্যই চুপ থাকতে হবে।” আনন্দবাজারের সামনে অবশেষে সেই ‘নৈঃশব্দ’ ভাঙলেন সাগরিকা। বললেন, “কেন ভারত সরকার ব্যাপারটা থেকে সরে দাঁড়িয়েছিল, কেনই বা আমি নরওয়ে ছেড়ে চলে এলাম, এখন তা সকলের জানার সময় এসেছে।” তাঁর অভিযোগ, অনুরূপ-অরুণাভাসের জন্যই তিনি নরওয়ে ছাড়তে বাধ্য হন। কেন?
কয়েক সেকেন্ড নিজেকে গুছিয়ে সাগরিকা কেটে কেটে বলেন, “আমাকে দিয়ে ওরা জবরদস্তি একটা চুক্তি সই করাতে চেয়েছিল। তাতে লেখা ছিল, আমাদের বিবাহবিচ্ছেদ হলে বাচ্চারা কাকার কাছে থাকবে। ওদের উপরে আমার দাবি থাকবে না। মা হয়ে কী করে মেনে নেব?” সাগরিকার অভিযোগ: তিনি চুক্তিতে সই করবেন না বলার পরে দু’ভাই তাঁর সঙ্গে দুর্ব্যবহার শুরু করে। “দিল্লিও হাত গুটিয়ে নেয়। আমি তখন স্ট্যাভাঙ্গারে এক বন্ধুর বাড়িতে গিয়ে উঠি। অসলোর ভারতীয় দূতাবাসে সব জানাই।” বলেন তিনি। আর তার পরেই বাচ্চাদের ফেরাতে সরকার ফের সক্রিয় হয় বলে তাঁর দাবি। আপত্তির অংশটুকু চুক্তি থেকে বাদ যায়। সেই চুক্তি সই করে ২৫ মার্চ সাগরিকা ভারতে চলে আসেন। তাঁর বক্তব্য, “আর গোলমাল চাইনি বলেই তখন নীরব ছিলাম।” ভট্টাচার্য পরিবারের তরফে অবশ্য ওঁর যাবতীয় অভিযোগ উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। উল্টে সাগরিকার দিকে আঙুল তুলে তাদের দাবি, মার সঙ্গে ‘যোগাযোগে’ সমস্যা ছিল বলেই নরওয়ের সংস্থাটি বাচ্চাদের নিয়ে গিয়েছিল। আসল সমস্যাটা কার, বার্নেভার্নের মূল্যায়ন-রিপোর্ট দেখলেই তা বোঝা যাবে বলে ভট্টাচার্য পরিবারের তরফে মন্তব্য করা হয়েছে।
অনুরূপ ফিরে এলে তাঁর সঙ্গে থাকবেন?
চোখ চলে গেল ল্যাপটপে। ধীর স্বরে জবাব এল, “ওদের তো বাবা, মা দু’জনকেই দরকার। তাই... থাকব।”
ল্যাপটপে হাসিমুখে অভিজ্ঞান-ঐশ্বর্যা।
দেশে ফেরার যুদ্ধটা যাদের জেতা হয়ে গিয়েছে। মা-বাবার কোলে ফিরতে হয়তো আরও যুদ্ধ বাকি। |