ইউরোপের অর্থনৈতিক সঙ্কটের কারণে ডলারের অনুপাতে হু হু করে কমেছে টাকার দাম। ফলে তেল আমদানির খরচ বেড়েছে। আর সে কারণেই পেট্রোলের দামের বিপুল বৃদ্ধি।
তা হলে কি ইউরোপের সঙ্কট কাটলে সুরাহা মিলবে?
অর্থনীতির অঙ্ক বলছে, সঙ্কট কেটে ইউরোপের পরিস্থিতি বদলালে সেখানকার দেশগুলিতে তেলের চাহিদা বাড়বে। চাহিদা বাড়লে অর্থনীতির নিয়মেই বাড়বে অশোধিত তেলের দাম। ফলে এ দেশে তেলের দাম কমানোর সুযোগটাই কমে যাবে।
এ যেন শাঁখের করাত!
অতীতে পেট্রোল বা ডিজেলের দাম বাড়ানোর ক্ষেত্রে প্রত্যেক বারই তেল সংস্থাগুলি আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দামবৃদ্ধির কথা বলেছে। কিন্তু গত কাল এমন দিনে পেট্রোলের দাম লিটারে সাড়ে সাত টাকা বাড়ানো হয়েছে, যে দিন আমদানি করা অশোধিত তেলের দাম ছিল সবথেকে কম! কিন্তু সে তো ডলারের হিসেবে। টাকার অবমূল্যায়নের ফলে হিসেব করতে গেলে দেখা যাচ্ছে, অশোধিত তেল আমদানির খরচ দাম লাফিয়ে বাড়ছে। ইন্ডিয়ান অয়েলের চেয়ারম্যান আর এস বুটোলার কথায়, “ডলারের হিসেবে অশোধিত তেলের দাম কমলেও টাকার হিসেবে তা অনেকটাই বেড়ে গিয়েছে। ডিজেল, রান্নার গ্যাস বা কেরোসিনে ক্ষতির দায় কেন্দ্রীয় সরকার নিলেও পেট্রোলে কোনও ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে না বলে সরকার দু’দিন আগেই চিঠি দিয়ে জানিয়ে দিয়েছে। তাই দাম বাড়ানো ছাড়া উপায় ছিল না।”
কিন্তু এখন আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের কম দামের কোনও সুবিধাই কি মিলবে না? বুটোলার জবাব, “অশোধিত তেলের দাম ও টাকার বিনিময় মূল্য, দু’টোর কথাই মাথায় রাখতে হবে। এখনও পর্যন্ত যা মনে হচ্ছে, অশোধিত তেলের দাম আরও কমতে পারে।” তেল সংস্থাগুলির ইঙ্গিত, ইউরোপের সঙ্কটের কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম কমার ধারা যদি বজায় থাকে এবং তার সঙ্গে যদি টাকার অবমূল্যায়নের বিষয়টি নিয়ন্ত্রণে থাকে, তা হলে তেলের দাম কমানোর পথে হাঁটতে পারে তারা। কারণ ইউরোপের সঙ্কট এখনই মিটে যাওয়ার আশা কম। ফলে বিশ্ববাজারে তেলের দাম বাড়ার সম্ভাবনাও কম। প্রসঙ্গত এ দিনই টাকার দাম ডলারের তুলনায় ৭৩ পয়সা বেড়েছে। ১ জুন তেল সংস্থাগুলি পরিস্থিতি পর্যালোচনায় বসবে। সেখানেই পেট্রোলের দাম কমানোর বিষয়ে সিদ্ধান্ত হবে।
কেন আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম কমছে? |
জ্বালানি বিশেষজ্ঞ সংস্থা প্লাট্স-এর মতে, উৎপাদন বাড়লেও কমেছে চাহিদা। ফলে অশোধিত তেলের দাম কমেছে। অথচ এ বছরের গোড়ার দিকে ইউরো-সঙ্কটের ফলে তেলের দাম বাড়তে শুরু করেছিল। সেই সঙ্গে যোগ হয়েছিল ইরান-সমস্যা। কিন্তু এখন ইরান-সমস্যা অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে। পরমাণু অস্ত্রসম্ভার নিয়ে রাষ্ট্রপুঞ্জের নিরাপত্তা পরিষদের সঙ্গে গত কাল থেকে আলোচনা শুরু করেছে তেহরান। ফলে ইরানের তেল নিয়ে অনিশ্চয়তা কাটছে। কিন্তু চাহিদার হিসেবে দেখা যাচ্ছে, আমেরিকা ও ইউরোপের আর্থিক সঙ্কটের প্রভাব সেখানে স্পষ্ট। সেখানকার মানুষের রোজগার কমেছে, অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডেও ঝিমুনি এসেছে। ফলে তেলের চাহিদা কমেছে। তার মধ্যেই তেল উৎপাদনকারী দেশগুলির সংগঠন ওপেক গত মাসে তেল উৎপাদন বাড়িয়েছে। ফলে জোগান বাড়লেও চাহিদা কমায় অর্থনীতির নিয়মেই আন্তর্জাতিক বাজারে কমছে অশোধিত তেলের দাম। ঠিক এর উল্টোটা হবে আমেরিকা-ইউরোপের আর্থিক সঙ্কট কাটলে। অর্থনীতি চাঙ্গা হয়ে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে সেখানে তেলের চাহিদা বাড়বে। ফলে বাড়বে দামও। তখন এ দেশেও তেলের দাম বাড়ানো ছাড়া উপায় থাকবে না।
তেল সংস্থাগুলির কর্তারা আজ স্বীকার করে নিয়েছেন, বাজারের ওঠানামার সঙ্গে পেট্রোল বা অন্যান্য জ্বালানির দাম ওঠানামা করলে সাধারণ মানুষের উপরে ধাক্কাটা অনেক কম লাগে। শেষ বার দাম বৃদ্ধির পরে একটা সময় পেট্রোলে লিটার প্রতি ৮ থেকে ১০ টাকা ক্ষতি হয়েছে। তেল সংস্থার কর্তাদের বক্তব্য, পেট্রোলের দাম এখনই না বাড়ালে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেত। দৈনিক ক্ষতির পরিমাণ ৫০ কোটিতে পৌঁছতো। নতুন অর্থবর্ষের দু’মাসও কাটেনি। এর মধ্যেই তিনটি রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থার পেট্রোলে ক্ষতির পরিমাণ ২৪০০ কোটি টাকার কাছাকাছি পৌঁছেছে। ইন্ডিয়ান অয়েলের চেয়ারম্যান বলেন, “আমরা সরকারের কাছে জানতে চেয়েছিলাম, পেট্রোল বাবদ ক্ষতিপূরণ দেওয়া হবে কি না। কিন্তু দু’দিন আগে সরকার জানিয়ে দেয়, ডিজেল, রান্নার গ্যাস, কেরোসিন বাবদ যে ১ লক্ষ ৩৮ হাজার ৫৪১ কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে, তার দায় তারা নেবে। পেট্রোলের ক্ষতিপূরণ পাওয়া যাবে না বুঝেই আমরা দাম বাড়াই।”
অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায় আজ ফের জানিয়ে দিয়েছেন, পেট্রোলের দামের উপর এখন সরকারি নিয়ন্ত্রণ নেই। তেল সংস্থাগুলিই দাম ঠিক করে। কিন্তু আর্থিক সংস্কার ও রাজকোষ ঘাটতিতে রাশ টানার পথে হেঁটে এ বার ডিজেল ও রান্নার গ্যাসের দামও বাড়বে কি না, সেই সিদ্ধান্তের দায়িত্ব প্রণববাবুর নেতৃত্বাধীন বিশেষ ক্ষমতাসম্পন্ন মন্ত্রিগোষ্ঠীর কাঁধেই রয়েছে। আগামিকালই সেই বৈঠক বসবে বলে জল্পনা চললেও সরকারি সূত্রের বক্তব্য, বৃহস্পতিবার রাত পর্যন্ত তেমন কোনও ইঙ্গিত নেই। কারণ প্রণববাবু ছাড়া মন্ত্রিগোষ্ঠীর বাকি ছয় সদস্যের মধ্যে এক মাত্র পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী এস জয়পাল রেড্ডি আজই বিদেশ থেকে ফিরেছেন। বাকি পাঁচ জনের মধ্যে চার জন, শরদ পওয়ার, সুশীল শিণ্ডে, এম কে আলাগিরি ও মন্টেক সিংহ অহলুওয়ালিয়া বিদেশে। মুকুল রায় পুর-নির্বাচনের জন্য পশ্চিমবঙ্গে ব্যস্ত। কাজেই এখনই ডিজেল-রান্নার গ্যাসের দাম বাড়ার সম্ভাবনা ক্ষীণ। পেট্রোলিয়াম মন্ত্রক অবশ্য মনে করছে, দাম বাড়ার পরে ডিজেলের সঙ্গে পেট্রোলের ব্যবধান অনেকটাই বেড়েছে। ফলে পেট্রোল চালিত গাড়ির বদলে অনেকেই ডিজেল চালিত গাড়ির দিকে ঝুঁকবেন। সরকারের ভর্তুকির অপব্যয় হবে। ফলে ডিজেলের দামও বাড়ানো উচিত। সংবাদসংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, বাজার ধরে রাখতে গাড়ি নির্মাতা সংস্থাগুলি ইতিমধ্যেই পেট্রোল গাড়িতে বিপুল ছাড়ের কথা ঘোষণা করেছে। |
শেষ পাঁচ দিনের আমদানি |
পেট্রোল দিনভর |
দিন |
ডলারে* |
টাকায় |
টাকার বিনিময়মূল্য |
• ডলারের তুলনায় টাকা বাড়ল ৭৩ পয়সা
• দাম কমাতে বলেনি সরকার, জানাল ইন্ডিয়ান অয়েল
• পেট্রোলের দাম নিয়ে আবার পর্যালোচনা ১ জুন
• বিক্রয়কর কমাল কেরল, উত্তরাখণ্ড
• কংগ্রেস চায়, মানুষকে সুরাহা দিতে বিহিত করুক সরকার
• ৩১শে বন্ধ ডাকল বিজেপি, বামেদের প্রতিবাদ দিবস |
২৩ মে |
১০৪.৮২ |
৫৮৬২.৫৮ |
৫৫.৯৩ |
২২ মে |
১০৬.৯৫ |
৫৮৬৯.৪২ |
৫৪.৮৮ |
২১ মে |
১০৬.৪৩ |
৫৮১৯.৫৯ |
৫৪.৬৮ |
১৮ মে |
১০৫.৭৯ |
৫৮১৯.৫৯ |
৫৪.৮৮ |
১৭ মে |
১০৭.৮৭ |
৫৮৬৭.০৫ |
৫৪.৩৯ |
|
পেট্রোল-গাড়ির দামে ছাড়ের ইঙ্গিত |
রাষ্ট্রায়ত্ত তেল সংস্থাগুলি বুধবার পেট্রোলের দাম বাড়ানোর পর দিনই নির্মাতা সংস্থাগুলি পেট্রোল-গাড়ির দামে ছাড় দেওয়ার কথা ঘোষণা করল। সংবাদসংস্থা পিটিআই জানিয়েছে, মারুতি সুজুকি, টাটা মোটরস এবং হুন্ডাই মোটর সীমিত সময়ের জন্য এই ছাড় দিচ্ছে। বৃহস্পতিবার মারুতি-সুজুকির ম্যানেজিং এগ্জিকিউটিভ অফিসার (বিপণন) ময়াঙ্ক পারেখ জানান, তাঁদের অল্টো গাড়ির বিক্রি কমেছে মাসে ৫ থেকে ৬ হাজার। তাই ওই গাড়িতে মে মাসের শেষ পর্যন্ত ৩০,০০০ টাকা ছাড় দেওয়া হবে। অন্যান্য গাড়ির পেট্রোল মডেলেও ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা পর্যন্ত ছাড় দেবে সংস্থা। টাটা মোটরসও তাদের ইন্ডিগো এবং ইন্ডিকা গাড়ির পেট্রোল মডেলে ৫০ হাজার টাকা পর্যন্ত ছাড় দেবে বলে জানিয়েছে। ন্যানোর ক্ষেত্রে মে মাসে ১০,০০০ টাকা ছাড় দিচ্ছে সংস্থা। হুন্ডাই মোটরের ডিরেক্টর (বিপণন) অরবিন্দ সাক্সেনা জানান, চলতি মাসের শেষ পর্যন্ত আই-১০, আই-২০, স্যান্ট্রো-সহ বিভিন্ন গাড়ির পেট্রোল মডেলে ৩,০০০ পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হবে। |