সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা পরিমাপের মাপকাঠি কী? এই প্রশ্নের একটিমাত্র উত্তর সম্ভব রাজ্যের উন্নয়নকল্পে সরকার কতখানি যত্নবান, তাহার মাধ্যমেই সরকারের সাফল্য-ব্যর্থতা দেখিতে হইবে। উন্নয়ন বলিতে ‘ধান-চালের অর্থনীতি’-র উন্নয়ন নহে, সেই কূপ হইতে উত্তরণই উন্নয়ন। সরকার বৃহৎ শিল্পের আবাহনে কতখানি উদ্যোগী হইল, তাহাই উন্নয়নের মাপকাঠি। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের প্রথম এক বৎসরকে এই মাপকাঠিতে বিচার করাই বাঞ্ছনীয়। পশ্চিমবঙ্গে বৃহৎ বিনিয়োগ স্বতঃপ্রণোদিত হইয়া আসে না। কেন, তাহা সর্বজনজ্ঞাত। এই রাজ্যে বৃহৎ বিনিয়োগকে আমন্ত্রণ করিয়া আনিতে হইবে, তাহার অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করিতে হইবে। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের পূর্বসূরি বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য খানিক চেষ্টা করিয়াছিলেন বিবিধ কারণে সেই চেষ্টা ফলপ্রসূ হয় নাই। মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় এবং তাঁহার রাজনীতি সেই ব্যর্থতার একটি কারণ। অতএব, শ্রীবন্দ্যোপাধ্যায়ের দায়িত্ব দ্বিগুণ অতীত পাপস্খালনের দায়িত্ব; বর্তমান পদের দায়িত্ব। তাঁহার মুখ্যমন্ত্রিত্বের প্রথম এক বৎসরে তিনি সেই দায়িত্ব কতখানি পালন করিলেন?
বিগত এক বৎসর এই প্রশ্নটির বিশেষ ইতিবাচক উত্তর দেয় নাই। প্রশাসক হিসাবে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে বার্তা প্রেরণ করিয়াছেন, তাহা আশাপ্রদ নহে। এই রাজ্যের প্রশাসন লইয়া সংশয় অনেক। গত এক বৎসরে বারে বারে বোধ হইয়াছে, এই প্রশাসন, সর্ব স্তরেই, অযোগ্য। সাধারণ কর্মী হইতে মন্ত্রী, কেহই নিতান্ত দিনগত পাপক্ষয়ের বাহিরে ভাবিতে চাহেন নাই। এই রাজ্যের আইনশৃঙ্খলা বিষয়ে গত এক বৎসরে গভীর উদ্বেগ সৃষ্টি হইয়াছে। পার্ক স্ট্রিট কাণ্ড হইতে আরাবুল ইসলামের কীর্তি, নানা উপলক্ষে পুলিশের অকর্মণ্যতা এবং ক্ষেত্রবিশেষে নির্লজ্জ পক্ষপাত কোনও ঘটনাই মানুষকে সুশাসনের আশ্বাস দেয় না। উদ্বেগের আরও কারণ, যিনি এই রাজ্যের সর্বাধিনায়ক, তিনি স্বয়ং এই শাসনের অভাবকে বিবিধ অজুহাতে ঢাকিতে চাহিয়াছেন। অন্য দিকে, রাজ্যের নানা প্রান্তে তৃণমূল কংগ্রেসের স্থানীয় নেতাদের বিরুদ্ধে তোলাবাজির অভিযোগ বাড়িতেছে। অভিযোগগুলি ভিত্তিহীন বলিয়া ধরিয়া লইবার কারণ নাই। আর, বাম শাসনকালে যে দলতন্ত্র রাজ্যের অভিজ্ঞান হইয়া উঠিয়াছিল, তাহাও, রাজ্যবাসীর দুর্ভাগ্য, অন্তর্হিত হয় নাই। দলের রঙ বদলাইয়াছে মাত্র। ঘটনাগুলি বিনিয়োগকারীদের চোখ এড়াইয়া গিয়াছে, এমন ভাবিয়া লওয়ার কোনও কারণ নাই। তাঁহারা দেখিয়াছেন, এবং বুঝিয়াছেন পশ্চিমবঙ্গ বদলায় নাই।
প্রশাসনিক অক্ষমতা ও অনাচারের সহিত রহিয়াছে ব্যক্তিগত ও দলগত অসহিষ্ণুতা। সম্প্রতি তৃণমূল কংগ্রেস নেতারা যে অসহিষ্ণুতার পরিচয় দিতেছেন, তাহা ভয়াবহ। মন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক সি পি আই এম কর্মী-সমর্থকদের সামাজিক ভাবে বয়কটের ফতোয়া জারি করিয়াছেন। একটি ব্যঙ্গচিত্র প্রেরণ করিবার ‘অপরাধে’ এক শিক্ষককে হেনস্থা করা হইল। অনুমান করা সম্ভব, নেত্রীর অনুমোদন ছাড়া এইগুলি সম্ভব ছিল না। আর, অনুমানের প্রয়োজন কী? স্বয়ং মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় একটি সর্বভারতীয় টেলিভিশন চ্যানেলের অনুষ্ঠানে কয়েক জন ছাত্রছাত্রীর প্রশ্নের উত্তরে যে আচরণ করিয়াছেন, তাহা অসহিষ্ণুতার অবিশ্বাস্য উদাহরণ। নেত্রীর আচরণ দলকে, এবং পশ্চিমবঙ্গের ন্যায় রাজ্যে প্রশাসনকেও, কোন পথে চালিত করিবে? এমন অসহিষ্ণুতার বাতাবরণে শিল্প হয় না। মুখ্যমন্ত্রীর সতর্ক হওয়া বিধেয়। তিনি যে দলের প্রধান, সে দলটি অতিমাত্রায় ব্যক্তিনির্ভর। সেই ব্যক্তি স্বয়ং তিনি। কাজেই, তিনি অসহিষ্ণু হইলে, ‘জেদি’ হইলে পারিষদদলে তাঁহার অনুকরণ করিবে এবং শতগুণ করিবে। ফল পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে ভাল হইবে না।
শেষে স্মরণ করাইয়া দিবার, মুখ্যমন্ত্রী যদি বৃহৎ শিল্প চাহেন, তবে তাঁহাকে বৃহতের পূজারি হইতে হইবে। রাস্তার রেলিং-এর রঙ বদলাইয়া নীল-সাদা করা, প্রগতি মেলার আয়োজন করা বা বঙ্গবিভূষণ সম্মানের আয়োজন করিবার ন্যায় ক্ষুদ্রের সাধনায় তিনি আটকাইয়া পড়িলে সেই ক্ষুদ্রই সার হইবে। বৃহতে উত্তরণ আর হইবে না। তাঁহাকে বড় করিয়া ভাবিতে হইবে। প্রয়োজনে, তেমন ভাবে ভাবিতে শিখিতে হইবে। কিন্তু, তাঁহার ভাবনার মাপ না বাড়িলে পশ্চিমবঙ্গে উন্নয়ন অধরা থাকিবে। তাঁহার পূর্বসূরিরা চৌত্রিশ বৎসর ক্ষুদ্রের সাধনা করিয়াছেন। আর নহে। |