করল, লড়ল, জিতল... দিল্লিকে উড়িয়ে
অবশেষে ফাইনালে ‘ডনের’ কলকাতা
রব লড়ব জিতব, চেন্নাইতে ফাইনাল খেলব রে!
প্রেসবক্সে বসে লাইনটা লিখতে লিখতে দেখছি কালো টি শার্টে সামনে দিয়ে মাঠ ঘুরছেন শাহরুখ খান। সঙ্গে তিনটি বাচ্চা। গ্যালারি ফেটে পড়ছে হাততালিতে। আর তিনি মাথা ঝুঁকিয়ে বলছেন, ধন্যবাদ আপনাদের। ভাবখানা এমন যে, আপনাদের কুর্নিশ করছি। কারণ এই মাঠ আমার টিমকে পাঁচ বছরে প্রথম আইপিএল ফাইনালে তুলে দিল। ওয়াংখেড়েতে যে বাচ্চাদের নিয়ে মাঠে নামতে যাওয়ায় তাঁর বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছিল, এরা নির্ঘাত সেই দলে ছিল। দেখে মনে হচ্ছিল, কোথাও যেন এমসিএ কর্তাদের বিরুদ্ধেও প্রতীকী ভিকট্রি ল্যাপ। দ্যাখ দ্যাখ, খুলে আম পুণে স্টেডিয়ামে ঘুরছি। বাচ্চাদের নিয়েই ঘুরছি। আর ফাইনালেও চলে গেলাম রে!
মঙ্গলবার দুপুরেও এক শীর্ষ কেকেআর কর্তা ক্ষোভ প্রকাশ করে যাচ্ছিলেন আইপিএল সিইও সম্পর্কে। বলছিলেন, “সুন্দর রামন আজ অবধি একটা প্রকাশ্য বিবৃতিও দেয়নি। অথচ ওয়াংখেড়েতে ঘটনার সময়ে পাশেই দাঁড়িয়েছিল।” এ দিনের খেলার পর শাহরুখকে দেখে মনে হল, ওই একটা ভিকট্রি ল্যাপের পর ওয়াংখেড়ে এখন তাঁর কাছে পিছনে ফেলে আসা ছাইয়ের গুদাম। সামনে বরঞ্চ প্রতিজ্ঞার আগুন। এ বার রবিবার ফাইনালটাও যদি ছিনিয়ে নিতে পারেন, তাঁর জীবনে অস্কার জয় ঘটে যাবে।
প্রচণ্ড প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ আইপিএল সেমিফাইনাল মানোপযোগী ম্যাচে কুতব মিনার সদৃশ দিল্লি ব্যাটিং লাইন আপকে থামিয়ে দিল নাইটরা। জিতল ১৮ রানে।
ম্যাচ শেষে কোথাও যেন মনে হচ্ছিল, ২ এপ্রিলের ওয়াংখেড়ে আর ২২ মে-র পুণে কি কোথাও এক সুরে গাঁথা? সেই বিশ্বকাপ ফাইনালের তিন মুখ্য চরিত্র এখানেও। তখনকার শ্রীলঙ্কা কোচ ট্রেভর বেলিস এখন কেকেআরে। সেই ওয়াংখেড়ের মতোই এক দিকে গৌতম গম্ভীর। অন্য দিকে মাহেলা জয়বর্ধনে। আজও আতসবাজির বিস্ফোরণ হল সেমিফাইনাল শেষে। ঝরে পড়ল মাঠময় রঙিন সব কাগজের টুকরো। ওয়াংখেড়ের সে দিনের মতো গম্ভীরের জন্যই সেগুলো বরাদ্দ ছিল, মাহেলা আবার শেষ করলেন হেরে। যদিও একটা সময় মনে হচ্ছিল, তাঁর ঝোড়ো ইনিংস নাইটদের পরিবারে সেই পরিচিত দুঃস্বপ্ন এনে দেবে।
আত্মহারা। প্রথম বার ফাইনালে ওঠার পর শাহরুখ।
দিল্লির কাছে এই মাঠ সারসের বাড়িতে শেয়ালের নেমন্তন্ন খাওয়ার মতো। ঈশপের গল্পটা গল্পই। কিন্তু টি-টোয়েন্টি ম্যাচ তো প্রখর বাস্তব যেখানে সম্পূর্ণ পেস-নির্ভর আক্রমণ নিয়ে তারা পুণের স্পিনিং ট্র্যাকে পড়েছে। তা-ও আবার টস হেরে বসে আছে। দিল্লিওয়ালাদের স্ট্র্যাটেজি খুব সহজ দেখাচ্ছিল। ম্যাচটাকে ১৬ ওভারের ধরো। নারিনের চারটে ওভার হিসেবে রেখো না। নাইটদের ইনিংস শুরু হওয়ার সময় সহবাগকে দেখে মনে হল আজ ধোনি মডেল নিয়েছেন। হতে পারে ধোনি তাঁর ভয়ঙ্কর অপছন্দের মানুষ। কিন্তু আজ তাঁর মতোই অচঞ্চল হাসিমুখ থেকে টিমকে চালাতে চান। এমন হাড্ডাহাড্ডি ম্যাচের আগে ডিডি যখন হাড্ল করছে, সহবাগ সেখান থেকে বেরোলেন হাসিমুখে। ভাবটা এমন, টেনশন লেনে কা নেহি, দেনে কা। ম্যাচ হারলে কী হবে, হাসিমুখ আগাগোড়া অব্যাহত। খেলার পর অবশ্য বাঁকা প্রশ্ন উঠেই পড়ল, রস টেলর আর ইরফানকে এত নীচে রেখে সহবাগ অনভিজ্ঞদের ওপরে পাঠিয়েছিলেন কেন? উত্তর পাওয়া গেল না। দিল্লি অধিনায়ক যে সাংবাদিক সম্মেলনে আসেননি।
খেলার কথায় ফিরি। প্রথম বল থেকেই চালাতে থাকা সহবাগকে তুলে নিলেন বালাজি। বিশাল একটা ঋণ শোধ করলেন নাইট সমর্থকদের কাছে। ইডেনে তাঁর একটা অভিশপ্ত ওভার গত বছর সমর্থকদের হৃদয় ভেঙে দেয়। ফাইনালে যাওয়াটা শুধু নাইটদের কাছে ঐতিহাসিক নয়। অনেকের ব্যক্তিগত কর্জ চোকানোর দিনও হয়ে থাকল। যেমন বালাজি। যেমন কালিস। যেমন ইউসুফ পাঠান।
দুপুরে ম্যারিয়ট হোটেলের লাউঞ্জে দেখলাম এক কেকেআর কর্তা আলোচনায় মেতেছিলেন পাঠানকে নিয়ে। স্থানীয় এক ক্রিকেটপ্রেমী তাঁকে যত বলছেন, ওর পিছনে ফালতু খরচ করেছেন, কর্তাটি তত পাঠানের সমর্থনে। শেষমেশ বললেন, “বালাজি আমাদের বলেছে নক আউট ম্যাচে ইউসুফের আসল চেহারা দেখবে। কথাটায় আমরা গুরুত্ব দিতে চাই।”
মঙ্গলবার রাতের পর কর্তাটি নিশ্চয়ই স্থানীয় ক্রিকেট উৎসাহীকে ফের মুখোমুখি দেখতে চাইবেন! অ্যাদ্দিন ১৫ ম্যাচে ইউসুফের রান ছিল মাত্র ১৫৩। গড় ১৭। স্ট্রাইক রেট মিডল অর্ডারে খেলা ফিনিশারের পক্ষে দুঃস্বপ্নের ১০৪। তার পরেও ইউসুফকে যেমন সস্নেহ ভাবে কেকেআর প্রতিপালন করেছে, তা এখন ভাবাই যায় না। শাহরুখ এই মনোভাবের জন্য ফ্র্যাঞ্চাইজিদের মধ্যে অবশ্যই বিশিষ্ট হয়ে থাকবেন।
ইউসুফ সেই ঋণের খানিকটা শোধ করলেন সুব্রত রায় স্টেডিয়ামে। ম্যান অফ দ্য ম্যাচ ইউসুফের ২১ বলে অপরাজিত ৪০ রানে তিনটে বাউন্ডারি, দু’টো ছক্কা। এক সময় তো কেকেআর দেড়শো পেরোবে ভাবাই যাচ্ছিল না। রোজকার মতো গম্ভীর দারুণ শুরু করে আউট হয়ে যাবেন। তার পরেই ব্যাপারটা গুরুগম্ভীর হয়ে পড়বে। তাঁর রান আউট খেলাটা ঘুরিয়ে দিল। কেকেআর ব্যাটিংয়ের ধাঁচটা গোটা মরসুম এ রকম।
কৌশলী নেতৃত্বে এল জয়।
গম্ভীর যত ক্ষণ ক্রিজে থাকেন, ওটা টি-টোয়েন্টি থাকে। তিনি আউট হওয়া মাত্র টেস্ট ক্রিকেট। দিল্লির মতো টিমের বিরুদ্ধে যেখানে ১৭৫ তোলার পরিষ্কার প্রয়োজন, সেখানে হল ১৬২। তা-ও লক্ষ্মীরতন শুক্ল-ইউসুফ পাঠান ২৪ বলে ৫৬ রান তোলার পর। টিম থেকে বারবার বাদ পড়া শরৎচন্দ্রের দুখি চরিত্রের মতো চির-অবহেলিত লক্ষ্মী চলতি মরসুমে দারুণ ফর্মে। কিন্তু ক্যাপ্টেনের বিশ্বাসভাজন নন বলে নিয়মিত ব্যাট পাচ্ছিলেন না। কখনও টিমে, কখনও বাদ। হতাশ হয়ে বলতেন, “দাদা পুণেতে এত করে চেয়েছিল। এরা সে ভাবে খেলালও না। যেতেও দিল না।” ম্যাচের পর গম্ভীরের মন্তব্যটা শোনা হল না তাঁর: লক্ষ্মীর ওই ইনিংসটা না হলে বোধহয় জিততাম না।
মনোজের চোট এ দিন প্রাক্তন বাংলা অধিনায়কের জন্য দরজা খুলে দেয়। গম্ভীরও যে বিসলার বদলে লক্ষ্মীকে নেন, তাতে বোঝা গেল অলরাউন্ড দক্ষতাকে তিনি গুরুত্ব দিচ্ছেন। ১১ বলে অপরাজিত ২৪-এর পর (৩x৪, ১x৬) চেন্নাইয়ের ফাইনালে অবশ্যই লক্ষ্মী থাকবেন। মুখ থুবড়ে পড়া রানরেটের মুখটা তিনিই খুলে দিলেন। টুর্নামেন্টের কঠিনতম বোলার মর্নি মর্কেলকে যা মারলেন, তা বাংলা ক্রিকেটের আন্তর্জাতিক সংগ্রহশালা শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করল।
পুণে ঠিক করতে পারছিল না কাকে সমর্থন করবে। শাহরুখ আগের দিন জিতে মাঠ হাঁটায় স্থানীয় সাংবাদিকেরা বলছিলেন, মাস্টার মুভ। পরের দিনের ক্রাউডটাকে সঙ্গে নিয়ে নিল। বাস্তবে দেখা গেল, তা হচ্ছে না। গম্ভীর আউট হওয়া পর্যন্ত দর্শক যা-ও বা সাপোর্ট করছিল, এর পর তারা ঘুরে গেল। ফের লক্ষ্মী-পাঠান দুঃসাহসিক ব্যাটিংয়ে ‘করব, লড়ব, জিতব রে’ চিৎকার তুলে দিলেন। চিৎকারটা ফের শুরু হল দিল্লি ইনিংসের ১৭তম ওভারে। তখনও টানটান ম্যাচ। অথচ সৌরভের হোম গ্রাউন্ড যেন হঠাৎই মিনি ইডেন। চতুর্দিকে কোরাস, ‘কে-কে-আর! কে-কে-আর!’
পুণে যে মাঠে অনেক স্বপ্ন নিয়ে আইপিএল অভিযানের দিকে এগোচ্ছিল, দাদা পরিচালনা করছিলেন যার, সেখানেই ভিকট্রি ল্যাপ দিতে থাকা খানের মাথায় আতসবাজির মুকুট। কে বলেছে আইপিএল জঘন্য? এটাই তো জীবন। এটাই তো সাহিত্য।


ছবি: এ এফ পি।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.