রাষ্ট্রপতি নির্বাচন যত এগিয়ে আসছে, কংগ্রেস শীর্ষ নেতৃত্বের সঙ্গে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সংঘাতের আশঙ্কা ততই জোরদার হয়ে উঠছে।
শেষ দিল্লি সফরে প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ এবং সনিয়া গাঁধীর সঙ্গে বৈঠকে মমতা জানিয়ে দিয়েছিলেন, রাজ্যের বিপর্যস্ত আর্থিক অবস্থায় কেন্দ্র যদি ঋণের সুদ-আসল মকুবের সিদ্ধান্ত না নেয়, তবে তার রাজনৈতিক পরিণতি সুখদায়ক হবে না। প্রধানমন্ত্রী তখন মমতাকে আশ্বাস দিয়েছিলেন, ২২ মে সংসদের অধিবেশন শেষ হওয়ার পরে কেন্দ্র সুদ-আসল মকুবের সিদ্ধান্ত নেবে।
এখন প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ মহল থেকে জানানো হচ্ছে, কেন্দ্র পশ্চিমবঙ্গকে বিভিন্ন ভাবে আর্থিক সাহায্য দিতে রাজি থাকলেও তিন বছরের জন্য ‘মোরাটরিয়াম’ কার্যত অসম্ভব। তাদের যুক্তি, বামফ্রন্ট সরকার বাজার থেকে যে ঋণ নিয়েছিল, তা শোধ করার দায় কেন্দ্রের হতে পারে না। এখন কেন্দ্র যদি পশ্চিমবঙ্গকে সাহায্য করে, তা হলে অখিলেশ সিংহ যাদব একই ভাবে মায়াবতীর জমানার ঋণ মেটানোর দাবি তুলবেন। লালু জমানার দায় নিতে বলবেন নীতীশ কুমার। কংগ্রেসের এক শীর্ষ নেতা বলেন, রাষ্ট্রপতির পদের প্রার্থীকে জিতিয়ে আনতে শুধু মমতা নন, মুলায়মের সমর্থনও বিশেষ প্রয়োজন। তাই অখিলেশকে অসন্তুষ্ট করে শুধু পশ্চিমবঙ্গকে অর্থ সাহায্য দেওয়া সম্ভব নয়।
কেন্দ্রের এই আচরণে ক্ষুব্ধ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়। তৃণমূল সূত্রে জানা যাচ্ছে, কেন্দ্র যদি শেষ পর্যন্ত ‘মোরাটরিয়ামে’ রাজি না হয়, তা হলে রাষ্ট্রপতি প্রার্থীকে জেতানোর প্রশ্নেও কংগ্রেসকে বেগ পেতে হবে। কংগ্রেস কাকে প্রার্থী করবে, তা এখনও স্পষ্ট করেনি। তবে প্রণব মুখোপাধ্যায়কে প্রার্থী করা নিয়ে মমতা যা বলেছেন, তা দেখে অনেকেই বুঝতে পারছেন, তৃণমূল এত সহজে কংগ্রেসকে রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের বৈতরণী পার হতে দিতে চায় না।
কেন্দ্র যে যুক্তি দিচ্ছে, তার বিপরীতে মমতাও সাম্প্রতিক দিল্লি সফরে প্রধানমন্ত্রীকে নিজের যুক্তি জানিয়েছেন। প্রশ্ন তুলেছেন, আগের বাম সরকার যখন বেহিসেবি ঋণ নিয়েছিল, তখন প্রথম ইউপিএ সরকারের তরফ থেকে কেন তাদের আর্থিক শৃঙ্খলা রক্ষার পরামর্শ দেওয়া হয়নি? আর আজ কেনই বা মমতাকে তার বোঝা বইতে হবে? তৃতীয় বর্ষপূর্তির নৈশভোজে প্রধানমন্ত্রী আমন্ত্রণ জানালেও মমতা নিজে হাজির না থেকে দূরত্ব রচনারও বার্তা দিয়েছেন। মমতার প্রতিনিধি হিসেবে এ দিনের নৈশভোজে ছিলেন সৌগত রায়, রত্না দে নাগ, কাকলি ঘোষদস্তিদার। দু’পক্ষই কিন্তু পরস্পরের সঙ্গে থাকার কথা বলছে। মমতা বারবার বলছেন, ইউপিএ-র থেকে সমর্থন প্রত্যাহার করতে তিনি রাজি নন। তিনি চান, ইউপিএ সরকার মেয়াদ পুরো করুক। কংগ্রেসের সলমন খুরশিদ থেকে শুরু করে অন্য নেতারাও বলে চলেছেন, মমতার মতো শরিককে হারাতে চান না তাঁরা। সে জন্য সব রকমের কৃচ্ছসাধন করতে তাঁরা প্রস্তুত।
মুখে এ কথা বললেও দুই শিবিরেই চলছে সেয়ানে-সেয়ানে কোলাকুলি। কংগ্রেস নেতারা বলছেন, ‘মোরাটরিয়াম’ দেওয়া সম্ভব নয়। কিন্তু রাষ্ট্রপতি নির্বাচন পর্যন্ত তৃণমূলকে সব রকম আশ্বাস দিতে হবে। মমতা যে শর্তে আর্থিক সাহায্য চান, তা যদি কেন্দ্র দিতে না পারে, সে ক্ষেত্রে মমতা কী করতে পারেন, তা নিয়েও বিশ্লেষণ চলছে কংগ্রেসে। তাদের নেতাদের মতে, মন্ত্রিসভা থেকে বেরিয়ে এসে বাইরে থেকে সমর্থন দিতে পারেন মমতা। কিন্তু সমর্থন প্রত্যাহার করতে চাইবেন না। কারণ প্রথমত, সে ক্ষেত্রে মুলায়ম বা অন্যদের সমর্থন নিয়ে সরকার টিকে যাবে। দ্বিতীয়ত, পঞ্চায়েত ভোটের আগে রাজ্য স্তরেও কংগ্রেসের সঙ্গে জোট ভাঙলে মমতারই লোকসান বলে মনে করে কংগ্রেস।
মমতা যদি কংগ্রেসের রাষ্ট্রপতি পদে প্রার্থীকে সমর্থন না করেন অথবা কংগ্রেস প্রার্থী যদি তৃণমূলের সমর্থন না পাওয়ায় জিততে না পারেন, তবে সেটি কিন্তু শুধুমাত্র রাষ্ট্রপতি নির্বাচনে জেতা-হারার প্রশ্ন নয়। ২০১৪ লোকসভা নির্বাচনের আগে কংগ্রেসের কাছে বিরাট বিপর্যয়। বিজেপিও সেটাই চাইছে। মমতা নিজে কখনও ইউপিএ ছেড়ে এনডিএ-তে যোগ দেওয়ার ইঙ্গিত না দিলেও তাঁর সঙ্গে বিজেপির কিছু শীর্ষ নেতা ঘনিষ্ঠ যোগাযোগ রাখছেন। এই যোগাযোগকে ‘ব্যক্তিগত সম্পর্ক’ বলে ব্যাখ্যা করলেও বিজেপির কৌশল হল, লোকসভা ভোটের আগে কংগ্রেস বিরোধিতাকে উস্কে দেওয়া। এ জন্য কংগ্রেসের এখনকার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ শরিককে ব্যবহার করতে চাইছেন তাঁরা। এই পরিস্থিতিতে মনোমহন-প্রণব যদি সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা ভুলে মমতাকে ব্যতিক্রমী সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দেন, সে ক্ষেত্রে কেন্দ্র-মমতার সংঘাতের অনিবার্যতা অনেকটাই আটকানো যাবে। আর যদি তা না হয়, তবে অদূর ভবিষ্যতে এই সংঘাত জাতীয় রাজনীতিতে ‘ক্লাইম্যাক্সে’ পৌঁছবে। |