দ্রোগবাইজম ও নতুন ঘরানায় চেলসি এখন নীল রক্তের দল
রআইপি ফুটবল! রেস্ট ইন পিস। শান্তিতে মহানিদ্রায় যাও ফুটবল।
সৌজন্য ফেসবুক ও টুইটার। চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনালের পরে দেখা যাচ্ছে, বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অনেকেই ফুটবলের জন্য জ্বালিয়েছেন শোকের মোমবাতি।
ফুটবল কি সত্যিই প্রয়াত?
বায়ার্ন মিউনিখের ফ্রি ফ্লোইং ফুটবলকে তছনছ করে চেলসির কাতানেচিও, বোল্ট সিস্টেমের ফুটবলের সিংহ গর্জন দেখেই অনেকের এই প্রশ্ন।
কোথায় মৃত্যু! মরতে মরতে বেঁচে উঠে চেলসি আসলে ফুটবলের জয়গানই রচনা করে গেল মিউনিখে। দাঁতে দাঁত যুদ্ধ, শেষ মিনিট পর্যন্ত হাল না ছাড়ার চিত্রনাট্য। শৃঙ্খলা, জমাট রক্ষণ, প্রতিআক্রমণ এটাও ফুটবল। কত চরিত্র, কত দর্শনকে জীবন্ত ও মৃত করে দিয়ে গেল নাটকীয় টাইব্রেকারের ফাইনালটা!

‘দ্রোগবাইজম’এর জন্ম: দিদিয়ের দ্রোগবার বয়স যখন দুই, তখন মারা যান যুগোস্লাভিয়ার প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো। মা দ্রোগবাকে ডাকতেন ‘টিটো’ বলে। জোটনিরপেক্ষ আন্দোলনে নেহরু-নাসেরের সঙ্গী টিটো একদা সোভিয়েত ইউনিয়নের আওতা থেকে বেরিয়ে দেখিয়েছিলেন ‘টিটোইজম’। আর আইভরি কোস্টের দ্রোগবা ফুটবলে দেখালেন দ্রোগবাইজম। সেটা কী? একেবারে যান্ত্রিক ঢংয়ে নেমে-উঠে ফুটবল। জয় ছাড়া কিছুই যেন স্পর্শ করে না তাঁকে। ৮৮ মিনিটে অসাধারণ হেডে ১-১ করে চেলসিকে ম্যাচে ফিরিয়ে আনেন দ্রোগবা। অতিরিক্ত সময়ে রক্ষণ করতে নেমে তাঁর ট্রিপেই পেনাল্টি পায় বায়ার্ন। রবেন পেনাল্টিতে গোল করলে দ্রোগবা হতেন খলনায়ক। বদলে ঠান্ডা মাথায় টাইব্রেকারে শেষ গোল করে তিনিই মহানায়ক। ম্যাচ শেষে দ্রোগবা বলেছেন, “এই চিত্রনাট্য বহু আগেই কেউ ঠিক করে রেখেছিল।” এত অভিভূত!

চেলসিকে ইউরোপ সেরা করে দ্রোগবা। ছবি-রয়টার্স
বল পজেশনের মৃত্যু: ধর্মভীরু দ্রোগবার এই স্বীকারোক্তিকে উড়িয়ে দেবেন কী করে? ম্যাচটায় বল পজেশনে বায়ার্ন এগিয়েছিল ৫৫-৪৫। কর্নার (২০-১), গোলে শট (৭-৩), গোল লক্ষ করে শট (১৭-৩) সব কিছুতে বায়ার্ন এগিয়ে। সেমিফাইনালে চেলসির বিরুদ্ধে মেসির বার্সেলোনার ঝকঝকে পরিসংখ্যানও বায়ার্নের কাছে কিছু কিছু ক্ষেত্রে অনুজ্জ্বল। মেসি-জাভিদের বল পজেশন (৭২-২৮) ভাল ছিল। কিন্তু কর্নার (১০-১), গোলে শট (৫-৩), গোল লক্ষ করে শটের (১২-৪) বিচারে মেসিদেরও ছাপিয়ে গেছিলেন রবেন ও রিবেরি। মজা করে যে জুটিকে বলা হয় ‘রবেরি’। ম্যাচ শেষে ডাকাতিটা করে গেলেন কিন্তু দ্রোগবা-ল্যাম্পার্ডরাই। পুরনো দলের বিরুদ্ধে রবেন এমন মাঠ জুড়ে খেলেছেন, পেনাল্টি নষ্টের পরেও বিশ্বের সব কাগজ তাঁকেই সবচেয়ে বেশি নম্বর দিয়েছে। ১০-এ ৯। তাতে লাভ কী হল? ম্যাচটার পরে রবেনকে জড়িয়ে সান্ত্বনা দিচ্ছিলেন দ্রোগবা। দেখে মনে হচ্ছিল, পেনাল্টিতে গোলটা হলে উল্টো দৃশ্যও হতে পারত।

অবহেলিত এক কোচের জন্ম: আপনি এখন কী করবেন? চেলসির ইতালিয়ান কোচ রবের্তো দি’মাতিও প্রশ্ন শুনে বলেছেন, “আমি এখন ছুটি কাটাতে যাচ্ছি।” নীল রংয়ের চেলসিকে ইউরোপের নীল রক্তের অভিজাত দলে এনেও তাঁর ভবিষ্যৎ অনিশ্চিত। অতীতে দেল বস্কি, জাপ হেইঙ্কেসদের মতো কোচেরা ক্লাবকে ইউরোপ চ্যাম্পিয়ন করার পরেও তাঁদের ছুড়ে ফেলেছে রিয়াল মাদ্রিদ। এ বার দি’মাতিওর ভবিষ্যৎও কী কেউ জানে না। ফাইনালে ৪-২-৩-১ ছকটাকে ৪-৪-১-১ বা ৪-৫-১ বানিয়ে বায়ার্নের মাঝমাঠটাকে ধীরে ধীরে ক্লান্ত করে দেন ইতালিয়ান কোচ। একেবারে আনকোরা বারট্র্যান্ডকে নামিয়ে বায়ার্নের চেনা অঙ্ক এলোমেলো করে দেন। তিনি নিজে আরিগো সাক্কির ভক্ত। সাক্কির স্টাইলটাকে চমৎকার অনুসরণ করলেন। ৮৮ মিনিটে দ্রোগবার গোলটার পরে মিউনিখ দেখল অন্য এক চেলসিকে। বুঝতে দিলেন না, চার সেরা ফুটবলার হাতে নেই। তবু শেষ দৃশ্যে তিনি অবহেলিতই।

জার্মান ঘরানার মৃত্যু: আর বলা যাবে না, টাইব্রেকারে জার্মানরা অরণ্যদেব। অমর। জার্মান ফুটবলের সেরা বিজ্ঞাপন সোয়াইনস্টাইগার শেষ পেনাল্টি কিকটা পোস্টে মারার সঙ্গে সঙ্গে একটি মিথের মৃত্যু ঘটল। পেনাল্টির পরিসংখ্যান নিলে দেখা যায়, জার্মানরা অন্য দেশের থেকে এগিয়ে। কেন আপনারা পেনাল্টি নষ্ট কম করেন, প্রশ্নটা বায়ার্ন কোচ হেইঙ্কেসের সাংবাদিক সম্মেলনেও উঠেছিল। গড়পরতা জার্মানদের মতো তিনিও আগের দিন বলেছিলেন, সাফল্যের পিছনে ‘মেন্টালিটাট’। মানসিকতা। এই প্রথম বায়ার্নের টাইব্রেকার হারের পরে উত্তরটা অত সহজ হবে না। এই চ্যাম্পিয়ন্স লিগকে অনেকে মনে রাখবে সুপারস্টারদের পেনাল্টি নষ্টের জন্য। মেসি, রোনাল্ডো, কাকা, রবেন, সোয়াইনস্টাইগার...

নতুন তর্ক ও স্টাইলের জন্ম: অর্থ দিয়েই কি তা হলে ভবিষ্যতে ট্রফি কেনা যাবে? চেলসির প্রথম ইউরোপ জয় ওই প্রশ্নকেও উস্কে দিয়ে যাচ্ছে। আবুধাবির মালিকের উপচে পড়া অর্থে ম্যাঞ্চেস্টার সিটি এ বার ইংলিশ লিগ জিতেছে। তার পরে রাশিয়ান আব্রামোভিচের ইউরোপ জয়। বায়ার্ন মিউনিখ এমনিতে বার্সেলোনা, ম্যাঞ্চেস্টার ইউনাইটেডের ঘরানার ক্লাব। সেখানে স্লোগান নিজেদের ফুটবলার নিজেরাই তৈরি করো। বায়ার্ন তো সবসময় কম অর্থে দল গড়তে চায়! চেলসি? উল্টো। রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট পুতিনের বন্ধু আব্রামোভিচ ৯ বছর আগে চেলসি কিনেছিলেন রেকর্ড অর্থে। ১০০ কোটি পাউন্ড খরচ করেছেন দলটার পিছনে। কোচ ছেঁটেছেন ৮ বার। ফার্গুসন বা ওয়েঙ্গারের ঘরানার বাইরে এসে ১১টা দেশের ফুটবলারদের নিয়ে এক বিচিত্র স্টাইল বানিয়েছেন আব্রামোভিচ। সর্বত্র বৈপরীত্য।

ইতিহাসের মৃত্যু: জীবদ্দশায় অনেকেই আর দেখতে পাবেন না, ঘরের মাঠে চ্যাম্পিয়ন্স লিগ জিতে কোনও দলের উল্লাস। তিরাশি মিনিটে মুলারের হেডে গোলটা হওয়ার পরে মনে হচ্ছিল মিউনিখের মারিয়ন প্লাৎস, অলিম্পিক পার্ক, লেক, জোড়া গির্জা, মিউজিয়াম সব সাক্ষী থাকবে এই নতুন ইতিহাসের। ২ মিনিটের জন্য সব ধুলোয় গড়াগড়ি খেল। দ্রোগবার ওই জোরাল হেডে ছিল হাতির ডাকের আওয়াজ। বৃংহণ। দ্রোগবার দেশের ফুটবল দলের নাম “ল্যে এলিফঁস’ হাতির দল। চেলসি এখন হাতিকে রাখতে চাইছে।

বিশ্বসেরা ডিফেন্ডারের জন্ম: “আর্সেনাল ছেড়ে এই জন্যই আমি চেলসিতে এসেছিলাম,” ম্যাচটার পরে বলতে শোনা গেছে অ্যাশলে কোলকে। মেসি, জাভি, ইনিয়েস্তার পরে রবেন, রিবেবি, গোমেজকে যে ভাবে সামলালেন কোল, তাতে সন্দেহ নেই, তিনিই বিশ্বের সেরা লেফটব্যাক। কয়েক বার রবেনকে সামলাতে উঠে এসেছিলেন স্টপারদের ঘাড়ে। ইদানীং কোল খবর হয়েছেন মাঠের বাইরের ঘটনার জন্য। বিখ্যাত মডেল স্ত্রী চেরিলের সঙ্গে বিচ্ছেদ, নাইটক্লাবে পুলিশের সঙ্গে মারপিট, ছাত্রকে গুলি, যৌন কেলেঙ্কারি। তাঁর ফুটবল কিন্তু বেঁচে আছে এত কিছুর পরেও। পের চেক, টেরি, ল্যাম্পার্ড, দ্রোগবা ও কোল এই পাঁচটি খিলানের উপর দাঁড়িয়ে চেলসির নীল রঙা রাজপ্রাসাদ। পাঁচ জনের মধ্যে সবচেয়ে ধারাবাহিক কোলই।

শেষ হয়েও অশেষ: মিউনিখ কাঁদছে। কাঁদছেন সুন্দর ফুটবলের ভক্তরা, অভিসম্পাত দিচ্ছেন লন্ডনের ভাগ্যকে। আর তার মাঝে এত জন্ম, এত মৃত্যু নিয়ে অমর রূপকথা হয়ে রইল চ্যাম্পিয়ন্স লিগ ফাইনাল। ফুটবলকে অশেষ করে দিয়ে।




First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.