আমরা পুকুরের জল পান করিতে পারিলে আপনি পারিবেন না কেন? প্রশ্নটি ছুড়িয়া দিয়াছেন মালদহের মসানন্দপুরের নাগরিকরা। প্রশ্নের লক্ষ্য: অঞ্চলের বিধায়ক, ফরওয়ার্ড ব্লকের তজমুল হোসেন। ওই অঞ্চলে প্রবল জলাভাব। যথারীতি। বিধায়ক অবস্থা দেখিতে গিয়াছিলেন, তাঁহাকে দেখিয়া গ্রামবাসীদের ক্ষোভ উত্তাল হইয়া ওঠে। ইত্যবসরে বিধায়ক তৃষ্ণার্ত বোধ করেন। গ্রামবাসীরা পুকুরের জল আনিয়া দেন। প্রথমে দ্বিধাগ্রস্ত বোধ করিলেও শেষ পর্যন্ত পুকুরের জল পান করিয়াছেন। বিস্তীর্ণ গ্রামাঞ্চলে সহস্র সমস্যার প্রথম সারিতে অবশ্যই পরিস্রুত পানীয় জলের অভাব। বহু প্রাথমিক অভাবের মতোই এই অভাবটিও বহুলাংশে অপূর্ণ। গ্রীষ্মে সেই অপূর্ণতা অস্বাভাবিক অনটনে পরিণত হয়। কর্তৃপক্ষের নিকট আবেদন, নিবেদন, দাবি, বিক্ষোভ চলিতে থাকে। জবাবে প্রতিশ্রুতির প্লাবন বহিয়া যায়, সেই সকল প্রতিশ্রুতিও সচরাচর শূন্যকুম্ভবৎ। সুতরাং হরিশ্চন্দ্রপুরের বিধায়ক যে অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হইয়াছেন, তাহা বিস্ময়কর নহে।
অভিজ্ঞতাটি মূল্যবান। বিধায়ক জনপ্রতিনিধি। গণতন্ত্রে তাঁহার ভূমিকা জনসাধারণের প্রতিনিধিত্ব করিবার। বিধায়ক হিসাবে তাঁহার যে বিশেষ ভূমিকা এবং অধিকার, তাহা জনসাধারণের প্রতিনিধি হিসাবেই। তিনি যখন আইনসভায় কোনও বিষয়ে আপন মত জানান বা ভোট দান করেন, অথবা বিভিন্ন বিষয়ে শংসাপত্র দান করেন অথবা বিধায়ক তহবিল হইতে স্থানীয় উন্নয়নের জন্য অর্থ বরাদ্দ করেন অথবা অনুরূপ কোনও অধিকার প্রয়োগ করেন, তাহার কোনওটিই তাঁহার নিজস্ব বা ব্যক্তিগত অধিকার নয়, ওই জনপ্রতিনিধিত্বই তাহার উৎস। প্রশ্ন ওঠে, জনপ্রতিনিধি কি কেবল জনসাধারণের অভিমত বা দাবিদাওয়ার প্রতিনিধি, তাঁহাদের সুখদুঃখের অংশী নহেন? প্রতিনিধিত্বের যে অধিকার ব্যালট বাক্সে সংগৃহীত হয়, তাহা আইনি অধিকারমাত্র, যথার্থ জনপ্রতিনিধির নৈতিক অধিকার অর্জন করিতে হইলে কি সকলের সহিত ভাগ করিয়া অন্নপান করিতে হইবে না?
প্রশ্নটিকে বায়বীয় নৈতিকতায় সীমিত রাখিবার প্রয়োজন নাই, ইহার একটি বাস্তব দিকও আছে। দুনিয়ার অনেক দেশেই পানীয় জল সরবরাহের জন্য প্রশাসক বা রাজনীতিকের ব্যক্তিগত তাগিদ বা তৎপরতার কোনও প্রয়োজন হয় না, নিয়ম এবং ব্যবস্থা ব্যক্তিনিরপেক্ষ ভাবেই সেই কাজ সুচারু ভাবে সম্পাদন করিয়া থাকে। সেই আদর্শে পৌঁছাইতে এ দেশে এখনও কয়েক শতাব্দী অপেক্ষা করিতে হইবে বলিয়াই আশঙ্কা হয়। এখানে কর্তারা সচল এবং সরব হইলে তবেই কর্মের অগ্রগতি ঘটে। সুতরাং কর্তাব্যক্তিদের তাগিদ জাগ্রত হওয়া জরুরি। সাধারণ মানুষের যন্ত্রণা দূর করিবার তাগিদ রাজনীতি বা প্রশাসনের নায়কদের অন্তঃকরণ হইতে স্বতঃস্ফূর্ত হইলে মঙ্গল, কিন্তু সেই স্বতঃস্ফূর্তির উপর ভরসা করিয়া থাকা বুদ্ধিমানের কাজ নয়। জনজীবনের হালচাল ঠিক কেমন, কর্তারা তাহা জনসাধারণের সহিত মিশিয়া উপলব্ধি করিলে ভাল হয়। হরিশ্চন্দ্রপুরের বিধায়ক ঘরে ফিরিয়া শরীর ঠিক রাখিবার তাগিদে প্রয়োজনীয় প্রতিষেধক সেবন করিয়া থাকিলে তাঁহাকে দোষ দেওয়া যাইবে না, সাবধানের মার নাই। কিন্তু তাঁহার মন যে অভিজ্ঞতাটি সংগ্রহ করিয়াছে, তাহা কেবল মূল্যবান নয়, অতীব হিতকর। |