একটি আধুনিক অর্থনীতিতে সরকারের প্রধান ভূমিকা সুনির্দিষ্ট সরকার দেশের মানুষের স্বার্থরক্ষা করিবে। রাজনীতির পরিভাষায় যাহা ‘জনস্বার্থ’ নামে পরিচিত। সর্বাধিক মানুষ যাহাতে বাজারে প্রবেশাধিকার পাইতে পারে, তাহা নিশ্চিত করাই সরকারের কর্তব্য। সেই কাজটি করিবার কোনও ‘একক পন্থা’ নাই। যেখানে যান চলাচলের যোগ্য সড়ক নাই, সেখানে সড়ক তৈরি করিয়া দেওয়া যেমন জনস্বার্থ রক্ষা, তেমনই কর্মসংস্থান হইতে পারে, এমন শিল্পের জন্য অনুকূল পরিবেশ তৈরি করাও তাহাই। নূতন সড়কে গণ পরিবহণের ব্যবস্থা হইলে মানুষের লাভ, নূতন শিল্পে কর্মসংস্থান হইলেও মানুষের লাভ। জনস্বার্থকে এই বিস্তৃত অর্থে দেখাই বিধেয়। সংসদের স্থায়ী কমিটি ‘জনস্বার্থ’-কে একটি সঙ্কীর্ণ সংজ্ঞায় বন্দি করিয়াছে। সুপারিশ করিয়াছে, বেসরকারি শিল্পের জন্য সরকার জমি অধিগ্রহণ করিবে না। এই সুপারিশে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় প্রীত হইতে পারেন, জনস্বার্থ রক্ষিত হইবে না। বেসরকারি শিল্প মুনাফা করে, অতএব তাহার সহিত জনস্বার্থের যোগ নাই ইহা কুযুক্তি। বেসরকারি লৌহ-ইস্পাত কারখানা একটি অঞ্চলের অর্থনীতি কী ভাবে বদলাইয়া দিতে পারে, তাহার প্রমাণ ভারতেই রহিয়াছে। প্রত্যক্ষ কর্মসংস্থান, অনুসারী শিল্পের বিকাশ, স্থানীয় অর্থনীতিতে চাহিদা বৃদ্ধি, সব মিলাইয়া শিল্পের জনস্বার্থমূলক দিকটি অস্বীকার করিবার কোনও উপায় নাই। ইহার সহিত বিনিয়োগকারীর মুনাফা অর্জনের প্রচেষ্টার কোনও সংঘাত নাই, বরং সাযুজ্য রহিয়াছে। কেন্দ্রীয় গ্রামোন্নয়ন মন্ত্রী জয়রাম রমেশ এবং শিল্প ও বাণিজ্য মন্ত্রী আনন্দ শর্মা যথার্থ কারণেই কমিটির সুপারিশে আপত্তি জানাইয়াছেন। কেন শিল্পের জন্য প্রয়োজনীয় জমি জোগাড় করা বেসরকারি বিনিয়োগকারীর পক্ষে কার্যত অসম্ভব, তাহা বহু-আলোচিত। যত ক্ষণ না জমির যথার্থ বাজার গড়িয়া উঠিতেছে, তত ক্ষণ জনস্বার্থের কথা মাথায় রাখিয়াই বেসরকারি শিল্পের জন্য জমি অধিগ্রহণ করিয়া দেওয়া সরকারের কর্তব্যের অন্তর্ভুক্ত হওয়া বিধেয়।
সংসদের স্থায়ী কমিটির সুপারিশটি মূলত দুইটি বিশ্বাসের উপর দাঁড়াইয়া আছে। এক, বেসরকারি বিনিয়োগকারী যেহেতু মুনাফার লোভেই শিল্প গড়েন, ফলে সেই শিল্প জনস্বার্থ রক্ষা করিতে পারে না; দুই, কেবলমাত্র সরকারের পক্ষেই জনস্বার্থ রক্ষা করা সম্ভব। এই দুইটি বিশ্বাস পরস্পরের পরিপূরক। কোনওটিই ভুঁইফোড় নহে। বস্তুত, এই বিশ্বাসগুলি ভারতে প্রায় স্বাধীনতার সমান বয়সী। প্রথম বিশ্বাসটি কেন ভ্রান্ত, তাহা পূর্বেই আলোচিত হইয়াছে। দ্বিতীয় বিশ্বাসটি পরীক্ষণীয়। ঔপনিবেশিক শাসনের অবসান ঘটিবার পর দেশের নেতাদের একটি প্রধান লক্ষ্য ছিল মানুষকে উন্নয়নের আওতায় লইয়া আসা। জওহরলাল নেহরুর ভারতে স্থির হইয়াছিল, উন্নয়নের জন্য যাহা করিবার, সব রাষ্ট্র করিবে। অর্থনৈতিক যোজনা, বৃহৎ শিল্পের রাষ্ট্রায়ত্তকরণ, সবই সেই রাষ্ট্রের অমোঘতার ধারণা হইতে আসিয়াছে। মুশকিল হইল, সদ্য-স্বাধীন দেশে সমাজতন্ত্রের উচ্ছ্বাসে অর্থনীতির যুক্তি গুলাইয়া গিয়াছিল। বাহ্যিক এবং সামাজিক পরিকাঠামো গঠনের ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের ভূমিকা অপরিহার্য। এই পরিকাঠামো চরিত্রগত ভাবেই এমন সামাজিক পণ্য যে তাহার রাশ মূলত সরকারের হাতে থাকাই বিধেয়। কিন্তু, শিল্পক্ষেত্রে জনস্বার্থ রক্ষার জন্য কেন রাষ্ট্রকে দায়িত্ব লইতেই হইবে, সেই প্রশ্নের উত্তর নাই। বস্তুত শিল্পে, উৎপাদনে রাষ্ট্রের ভূমিকা যে প্রধানত পরোক্ষ, বেসরকারি ক্ষেত্রকে উপযুক্ত পরিবেশ তৈরি করিয়া দেওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ, এই কথাটি বিশ্বায়নোত্তর ভারতে প্রতিষ্ঠিত। কিন্তু, অতীতের বোঝা নামাইয়া রাখা কঠিন কাজ। ফলে, বেসরকারি ক্ষেত্রের সহিত জনস্বার্থের চরিত্রগত বিরোধের ভ্রান্ত ধারণাটি রাজনীতিকরা এখনও বহিয়া চলিতেছেন। হয়তো, সজ্ঞানে নহে। কিন্তু, সর্বত্র বিরাজমান সরকারের যে ভূত এখনও ভারতের ঘাড়ে চাপিয়া আছে, এই বার তাহার চিকিৎসা প্রয়োজন। |