গুজরাতে বিনিয়োগে কোনও রাজনৈতিক ঝুঁকি নেই জানিয়েছেন ফোর্ড ইন্ডিয়ার সর্বময় কর্তা মাইকেল বোনহম। ভারতে তাঁদের সংস্থার দ্বিতীয় কারখানা গুজরাতে খোলার সিদ্ধান্ত নেওয়ার ঠিক পরেই।
২০০৯ সালে এই বোনহমই কনফেডারেশন অফ ইন্ডিয়ান ইন্ডাস্ট্রি-এর বাৎসরিক বৈঠকে কলকাতায় এসেছিলেন। সান্ধ্যভোজের আসরে তাঁর আক্ষেপ ছিল একটাই বিনিয়োগের গন্তব্য হিসেবে পশ্চিমবঙ্গের সব আছে। তবুও কেন কিছু হচ্ছে না? এই প্রশ্নের উত্তর দিয়েছিলেন তিনি নিজেই। বলেছিলেন, এই রাজ্যে রয়েছে বিনিয়োগের মারণ বাণ: ‘পলিটিক্যাল রিস্ক’, রাজনৈতিক ঝুঁকি। অবশ্যই এই ধারণা সিঙ্গুর-উত্তর পশ্চিমবঙ্গ নিয়ে।
এখন গুজরাত শিল্পোন্নয়ন নিগমের ওয়েবসাইটে এই বোনহমের উক্তিকেই ব্যবহার করা হচ্ছে রাজ্যে বিনিয়োগের শংসাপত্র হিসেবে। কেন গুজরাত, সেই প্রশ্নে বোনহমের উক্তি “এখানে জমি পাওয়া সহজ।... অন্য জায়গার মতো বিনিয়োগ নিয়ে বিরোধিতা নেই।...বিনিয়োগ নিয়ে প্রশাসনের ব্যবহার ‘বিজনেস লাইক’।”
এর ফল? ২০১১-১২-র সরকারি হিসেব এখনও পাওয়া যায়নি। বেসরকারি হিসেবে গত বছর মন্দার বাজারেও ১ লক্ষ কোটি টাকার উপরে বিনিয়োগ এসেছে গুজরাতে। যার মধ্যে গাড়ি তৈরিতেই নতুন বিনিয়োগ প্রস্তাব ৪০ হাজার কোটি টাকার।
|
পাশাপাশি পশ্চিমবঙ্গের অঙ্ক এখনও পরিষ্কার নয়। তবে সরকারের দাবি, বিনিয়োগ প্রস্তাব এসেছে প্রায় ১ লক্ষ কোটি টাকা। যার মধ্যে রয়েছে প্রসূন মুখোপাধ্যায়ের ইউনিভার্সাল সাকসেস গোষ্ঠীর ৩২ হাজার কোটি টাকার বিনিয়োগ প্রস্তাব। এই বিনিয়োগকে নতুন প্রস্তাব হিসেবে ধরা হবে কি না, তা নিয়ে আবার দ্বিমত রয়েছে। দ্বিমত রয়েছে অন্য বিনিয়োগের হিসেব নিয়েও। কারণ এই প্রস্তাবের অনেকগুলি নিয়েই কাজ শুরু হয়েছিল বিগত বাম সরকারের আমলে। যে প্রকল্পগুলি নিয়ে দ্বিমত নেই, তার সম্মিলিত বিনিয়োগ মূল্য ১০ হাজার কোটি টাকার মতো।
কত টাকা বিনিয়োগ এসেছে, তা নিশ্চয়ই একটি রাজ্যের আর্থিক শক্তির পরিচয় দেয়। কিন্তু এই শক্তি অর্জনের আগের পাঠটাও জরুরি। আর তা হল আস্থা। এই আস্থাই বিনিয়োগ টানার অন্যতম চুম্বক।
সিঙ্গুরে জমি নিয়ে রাজনৈতিক বিরোধিতা টাটাদের তাড়িয়েছিল এই রাজ্য থেকে গুজরাতে। আর সেই টাটাদের টানেই মারুতি, পুজো সিট্রিয়ন এবং জেনারেল মোটরস লগ্নি প্রস্তাব নিয়ে গুজরাতে হাজির। কারণ তিনটে। এক, যন্ত্রাংশ তৈরির সংস্থারাও হাজির হয়েছে টাটাদের সঙ্গে। দুই, বিজেপি-র আমলে বিনিয়োগ করলে কংগ্রেস রাজত্বে তাদের বিজেপি-র লোক হিসেবে চিহ্নিত হয়ে পদে পদে হেনস্থা হতে হবে না। তিন, সরকার ব্যবসা বোঝে।
পশ্চিমবঙ্গ কিন্তু এই তিনটি সূচকেই এখনও ‘ফেল’। বিনিয়োগ ও ভাবমূর্তি বিতর্কে পরিসংখ্যান আসেই। |
পশ্চিমবঙ্গও এর ব্যতিক্রম নয়। আর যে সূচকটি সব সময় ব্যবহার করা হয় তা হল, ইন্ডাস্ট্রিয়াল অন্ত্রপ্রেনিওর্স মেমোরান্ডাম (আইইএম)। কেন্দ্রীয় সরকারের সেক্রেটারিয়েট অফ ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাপ্রুভালস-এর কাছে বিনিয়োগকারী তার প্রস্তাব জমা দেয়। এটা বিনিয়োগ পরিসংখ্যান তৈরি করতে ব্যবহার করা হয়।
২০১০ সালে পশ্চিমবঙ্গের জন্য প্রস্তাব ছিল ২০৯টি। বিনিয়োগের পরিমাণ ৪২৭৫৬ কোটি টাকা। মধ্যপ্রদেশ পেয়েছিল ২২৬টি। বিনিয়োগের পরিমাণ ২০৪২৮৬ কোটি টাকা। অঙ্ক সোজা। রাজ্যে প্রস্তাব পিছু বিনিয়োগের পরিমাণ ২০৪ কোটি টাকা। আর মধ্যপ্রদেশের এই অঙ্ক ছিল ৯০৩ কোটি টাকা।
এই গড় অঙ্কে একটা সমস্যা আছে। একটা বড় বিনিয়োগই গড় অঙ্ক এলোমেলো করে দিতে পারে। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গ এখনও সেই ছোট বিনিয়োগেই বাঁচে। হাজার কোটি টাকা বিনিয়োগ প্রস্তাব এলেই রাজ্যে খুশির বান বয়ে যায়। সংবাদমাধ্যমে শোরগোল ফেলে দেন মন্ত্রী-আমলারা। গুজরাত এই পরিমাণ লগ্নিকে আলোচনার যোগ্য বলেই মনে করে না। খবরের কাগজের ভেতরের পাতার এক কোণায় ঠাঁই হয় তার।
ফলে পশ্চিমবঙ্গের ক্ষেত্রে ওই গড় অঙ্কটা খুব একটা ভুল সূচক নয়। ২০১১-১২ সালের এই অঙ্ক এখনও পাওয়া যায়নি। কিন্তু রাজ্য সরকারের শিল্প দফতরের দাবি, রাজ্যের এই বছরের আইইএম ৮০টি। ২০১০ সালের তুলনায় যা অর্ধেকেরও কম।
মন্দার প্রকোপের যুক্তি না হয় মেনে নেওয়া গেল। কিন্তু ভাবমূর্তি?
সম্প্রতি এক সর্বভারতীয় বণিকসভার আসরে একান্ত আলাপচারিতায় একটি বড় সংস্থার প্রভাবশালী কর্তাকে রাজ্যে বিনিয়োগ নিয়ে তাঁর ভাবনাচিন্তার কথা জানতে চাওয়ায় তিনি বলেন, “কাগজে পড়লাম এক তৃণমূল কর্মী ন্যানো চড়ে দলীয় সভায় গিয়ে হেনস্থা হয়েছেন। তার পরেও জিজ্ঞাসা করছেন? পাশাপাশি দেখুন, শিল্পোন্নয়ন নিগমের এমডি আবার তথ্য ও সংস্কৃতি দফতর সামলাচ্ছেন। বিনিয়োগ টানতে যে রাজ্য দায়বদ্ধ, সেখানে এই সব ঘটনা কি ঠিক বার্তা পাঠাচ্ছে? জমি কিনব আমি, কিন্তু তার পরে তার বিনিয়োগ অনুমোদন করবে সরকারি কমিটি। কেন? সব নিয়ম মানার পরেই তো বিনিয়োগের অনুমতি মেলে। জমি কেনার পরে কমিটির যদি আমার মুখ পছন্দ না হয়?”
সমস্যা এখানেই।
মধ্য সত্তর থেকে পরিবর্তনের এক বছর পূর্তি রাজ্যের শিল্পোন্নয়ন পর্যালোচনা হয়ে উঠেছে ভাবমূর্তির পর্যালোচনা কিংবা বিনিয়োগের রাজনৈতিক ঝুঁকি। বামফ্রন্টের এটা বুঝতে সময় লেগেছিল ৩০ বছর। আশা একটাই।
বর্তমান সরকারের দ্বিতীয় বর্ষপূর্তিতে হয়তো ছবিটা বদলাবে।
|
(সহ প্রতিবেদন: দেবপ্রিয় সেনগুপ্ত) |