এখনই দশে দশ নয়। আপাতত দশে ছয় থেকে সাত নম্বরে ঘোরাফেরা করছে রিপোর্ট কার্ড।
বর্ষপূর্তিতে নতুন সরকারের কাজের খতিয়ান বিশ্লেষণ করতে গিয়ে এই মতামত দিয়েছে শিল্পমহল।
১৮২৫ দিন শাসন করার দায়িত্ব নিয়ে এসেছে নয়া সরকার। কেটেছে মাত্র ৩৬৫ দিন। তাই এখনই ‘মিডাস টাচ’ আশা করে না রাজ্যের কর্পোরেট মহল। তবে ৩৪ বছরের বাম শাসনকালে যে ভাবমূর্তির সমস্যা রাজ্যকে তাড়া করে ফিরেছে, তা কিছুটা ফিকে হওয়ার আশা করেছিল তারা। কিন্তু কেন্দ্রের যে কোনও সংস্কারে বাধা হয়ে দাঁড়ানো বা ভাড়া বৃদ্ধির জন্য রেলমন্ত্রী পরিবর্তনের মতো পদক্ষেপ সেই আশায় অনেকটাই জল ঢেলেছে বলে মনে করছে শিল্পমহল। তবে একই সঙ্গে শিল্পপতিদের অনেকেই মনে করছেন, নতুন সরকারের আমলে রাজ্যে শিল্প নিয়ে যে উৎসাহের পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তা লগ্নি টানার উপযোগী।
তবু আস্থার জায়গাটা এখনও প্রত্যাশা মতো পোক্ত হয়নি বলেই অভিযোগ শিল্পমহলের একাংশের। মার্কিন বিদেশ সচিব হিলারি ক্লিন্টনের কলকাতা সফরও লগ্নিকারীদের অস্বস্তি পুরোপুরি কাটাতে পারেনি। বেঙ্গল চেম্বার অফ কমার্সের প্রেসিডেন্ট হর্ষ ঝা জানান, কেন্দ্রের কাছ থেকে আর্থিক প্যাকেজ ছিনিয়ে আনতে সফল হবে রাজ্য। কিন্তু তার পরের পরিকল্পনা কোথায়? তিনি বলেন, “কোন পথে রাজ্যের আয় বাড়বে, সে বিষয়ে এখনও চুপ সরকার। কেন্দ্রের একাধিক সংস্কারের পথে বাধা তৈরি করেছে রাজ্যের বর্তমান শাসক দল। ভাড়া বাড়ানোর দায়ে রেলমন্ত্রীকে অপসারণ করেছে। তাই লগ্নি প্রস্তাব অনেকটাই খাতায়-কলমে থেকে গিয়েছে। রাজ্যে ব্যবসা বা লগ্নি করার ক্ষেত্রেও ভাবমূর্তির পরিবর্তন জরুরি।” প্রসঙ্গত, যে সংস্থার কর্তা হর্ষ ঝা, সেই টাটা মেটালিক্স-এর দ্বিতীয় পর্যায়ের লগ্নি বিগত সরকারের আমলে এ রাজ্য ছেড়ে চলে গিয়েছিল। কারণ জমি সমস্যা।
রাজ্যকে বিনিয়োগমুখী করে তোলার প্রশ্নে বেশি নম্বর না দিলেও রাজনৈতিক ও অন্য প্রশাসনিক কাজকর্মের ক্ষেত্রে রাজ্য সরকারকে ঢালাও নম্বর দিতে কার্পণ্য করেনি শিল্পমহল।
যেমন জঙ্গলমহল সমস্যা সমাধানে সাফল্য। বা বহু দিনের পুরনো পাহাড় সঙ্কটে সাময়িক স্বস্তি এনে দেওয়া। এ সব রাজনৈতিক সাফল্যকে বড় করে দেখছে বণিকসভাগুলি। মাথায় এক রাশ ঋণের বোঝা সামলেও এ ধরনের জটিল সমস্যা সমাধানের রাস্তা তৈরি করার জন্য মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের সরকারের প্রশংসা করেছে শিল্পমহল। সঙ্গে বন্ধ-এর মতো দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক হাতিয়ারের বিরুদ্ধে কড়া মনোভাবকে গুরুত্বপূর্ণ ও যথেষ্ট ইতিবাচক বলে মনে করছে তারা।
রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানে যে গতি দেখা গিয়েছে, তা শিল্পে অমিল। তবে এরই মধ্যে জমি আইন সংস্কারের মতো পদক্ষেপকে রুপোলি রেখা হিসেবে ধরছে শিল্পমহল।
ভারত চেম্বার অফ কমার্সের প্রেসিডেন্ট অশোক আইকত বলেন, “সরকারের সদিচ্ছা রয়েছে। সব কাজ তারা ঠিক করছে, এমন নয়। তবে জমি সংক্রান্ত সাম্প্রতিক সংস্কারের মতো নীতি তৈরি করে তারা ঠিক পথেই এগোতে চাইছে। আমাদের আশা, অন্যান্য ক্ষেত্রেও সংস্কারমুখী হবে সরকার।” পাশাপাশি লগ্নি টানার ক্ষেত্রে রাজ্যের আর্থিক দুরবস্থা কাটিয়ে তোলাই যে প্রথম কাজ, তা একযোগে জানিয়েছে সব বণিকসভাই। শিল্পমহলের বক্তব্য, দেউলিয়া সরকারের উপর ভরসা রেখে বিনিয়োগ করতে আসবে না কেউ।
রাজ্যে পট-পরিবর্তনের পরে শিল্পমহল জানিয়েছিল তারা ‘ওয়েট অ্যান্ড ওয়াচ’ পদ্ধতি অনুসরণ করবে। বর্ষপূর্তির ঠিক আগে তারা জানিয়েছে, এখনই তা থেকে সরে আসার সময় হয়নি। ফিকি-র পূর্বাঞ্চলীয় প্রধান গৌরব স্বরূপ বলেন, “লগ্নি টানার ক্ষেত্রে রাজ্যের নিজস্ব কিছু সহায়ক উপকরণ থাকলেও জমি, পরিকাঠামো ক্ষেত্রে দ্রুত উন্নয়ন প্রয়োজন।” একই সুরে বণিকসভা সিআইআই-এর পূর্বাঞ্চলীয় মুখপাত্র সৌগত মুখোপাধ্যায়ও জানান, জমি আইন সংশোধন ও এক জানলা ব্যবস্থা চালু করে সরকার বিনিয়োগ টানার অনুকূল পরিবেশ তৈরি করেছে।
শিল্পপতি সঞ্জীব গোয়েন্কা বলেন, “সারা বিশ্ব, ভারতবর্ষ এবং পশ্চিমবঙ্গ কিছু দিন ধরে কঠিন অর্থনৈতিক সঙ্কটের মধ্যে দিয়ে চলেছে। তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রথম বছরে নতুন সরকারের কৃতিত্ব উল্লেখযোগ্য। তা ছাড়া, সর্বত্র যে উৎসাহের পরিবেশ তৈরি হয়েছে, তা রাজ্যে লগ্নি টানার উপযোগী।”
তাই সব মিলিয়ে এখনই ‘ফুল মার্কস’ দিচ্ছে না শিল্পমহল। তবে যাতে তা দেওয়া যায়, সে জন্য ভবিষ্যতের দিকেই তাকিয়ে তারা। |