পুস্তক পরিচয় ১...
ইতিহাসের ছোট ও বড় সময়
নিজেরে হারায়ে খুঁজি (১-২ খণ্ড), অহীন্দ্র চৌধুরী। সপ্তর্ষি প্রকাশন, ৮০০.০০
ধুনা প্রয়াত অশীন দাশগুপ্ত মশাই তাঁর ইতিহাস ও সাহিত্য শীর্ষক ছোট্ট কিন্তু গভীর গ্রন্থে জানিয়েছিলেন, ইতিহাসের দুটো সময় হয়। বড় সময় ও ছোট সময়। রাজকাহিনি যদি বড় সময়ের অংশীদার হয়, তা হলে ব্যক্তির জীবন ঘিরে বয়ে চলে ছোট ছোট সময়ের ধারা। অগ্রজ অভিনেতা অহীন্দ্র চৌধুরী মশাইয়ের আত্মস্মৃতি নিজেরে হারায়ে খুঁজি-র মধ্যে এই দু’টি সময়ের ধারাই একে অন্যের সঙ্গে বিলগ্ন হয়ে আছে। গ্রন্থটি দু’টি খণ্ডে বিন্যস্ত, আয়তনে বিপুল, এবং ঘটনার সন্নিবেশে বহুমাত্রিক। সামান্য কিছু শব্দে এই বহুমাত্রিকতার আলোচনা সম্ভব নয় বলেই মনে করি। আমি, সংক্ষেপে, কয়েকটি বিষয়ের কথা উল্লেখ করতে চাই। প্রথমেই বলা দরকার, এই বহুমাত্রিক চলন এই বিশেষ আত্মকথাটির চিত্তাকর্ষক দিক, আবার একটি দুর্বলতাও বটে।
চিত্তাকর্ষক, কারণ এই বইটি পড়তে পড়তে ইতিহাসের বড় এবং ছোট সময় দুটোর ছবিই ধরা পড়ে। সাবেক উত্তর কলকাতার বাইরে কলকাতার দক্ষিণেও নগরটা গড়ে উঠছিল কী ভাবে, তার একটা ছবি এই গ্রন্থের পাতায় পাতায় হাজির। তৈরি হচ্ছে রাস্তা, গড়ে উঠছে বসতি, তার নিজস্ব সংস্কৃতি দেখা দিচ্ছে সময়ের বিভিন্ন বিন্দুতে। অর্থাৎ, যাকে বলা যেতে পারে নগরায়ণের ইতিহাস, আধুনিক নগর সংস্কৃতির ইতিহাস।
প্রতিকৃতি বই থেকে।
পাশাপাশি, ওই যা বলছিলাম, ছোট সময়। কী রকম ছোট সময়, একটু দেখে নেওয়া যাক। বাড়িতে লুকিয়ে ‘রিজিয়া’ নাটকে অভিনয় করতে গিয়েছেন কিশোর অহীন্দ্র। অভিনয় হল। নবীন অভিনেতার যাবতীয় দ্বন্দ্ব ও শঙ্কাকে উড়িয়ে ভালই হল বলা চলে। অতঃপর অহীন্দ্র চৌধুরী গভীর রাতে কেদার বসু লেন-এর ভাড়াটে বাড়িতে ফিরছেন। গেট টপকে পাঁচিল বেয়ে উঠে বৈঠকখানা ঘরের বারান্দায় পৌঁছলেন। চেয়ারে বসার একটু পরেই ভোর হয়ে এল। মৃদুমন্দ বাতাসে বুজে এল চক্ষু। নিদ্রাভঙ্গের পরে বুঝলেন, বাড়িতে মহা গোলযোগ হয়েছে। গোপন কথাটি আর সঙ্গোপনে নেই। ফাঁস হল কী ভাবে? প্রাতর্ভ্রমণে বেরোনোর সময় অহীন্দ্রের পিতৃদেব দেখেন, ছেলে চেয়ারে বসে নিদ্রারত, হাতে-মুখে লেগে আছে রঙের ছোপ!
অহীন্দ্র লিখছেন, ‘মা বললেন উনি বলেছেন তোমাকে বলতে যে, যদি ওই সব থিয়েটার-ফিয়েটার করো, তো তোমার বাড়িতে থাকা হবে না। তোমাকে আজ থেকে লেখাপড়া করতে হবে। এবং আজ থেকে তোমার বিকেলে বাইরে যাওয়া নিষেধ।’
এটা ছোট সময়ের একটা দিক। ব্যক্তিজীবন, পারিবারিক বৃত্ত। কিন্তু, তার মধ্যে তদানীন্তন বাঙালি মধ্যবিত্তের সংস্কৃতিচৈতন্যের একটা ছবিও স্পষ্ট।
আর একটি দিক খেয়াল করা যাক। গিরিশ ঘোষের পুত্র কিংবদন্তি নট দানীবাবুর অভিনয়ের কথা বলছেন অহীন্দ্র। ‘চন্দ্রগুপ্ত’ নাটকে ‘চাণক্য’-বেশী দানীবাবু নন্দকে অভিসম্পাত দিয়ে মঞ্চ থেকে প্রস্থান করছেন ‘তখন দেখবার জিনিস ছিল এই যে, তিনি ঘুরে দাঁড়িয়ে প্রস্থান করতেন না। পইতেটা হাতে করে যখন অভিশাপ দিচ্ছেন, সারা শরীরটা তখন তাঁর থরথর করে কাঁপত! এবং এই কাঁপতে কাঁপতেই সারা দেহটা পিছু হটতে থাকত। পিছু হটতে হটতে কেমন করে যে হঠাৎ উইংস-এর ভিতরে ঢুকে পড়তেন, ঠিক ধরতে পারতাম না।’
দানীবাবুর এই আশ্চর্য অভিনয় প্রতিভার সঙ্গে অহীন্দ্র একটি সঙ্গত প্রতিতুলনা টানছেন। বিশ্রুত ফরাসি মূকাভিনেতা মার্সেল মার্সো! ১৯৬০-এ কলকাতায় এসেছিলেন মার্সো। তাঁর মূকাভিনয় দেখলেন অহীন্দ্র। তাঁর কলাকৌশল শিক্ষার্থীদের দেখানোর বন্দোবস্ত করলেন। মার্সো বিনা পারিশ্রমিকেই আসতে রাজি, বাদ সাধল একটি হরতাল! নিরুপায় মার্সো কলকাতা ছেড়ে চলে গেলেন, রেখে গেলেন দু’টি রিল ষোলো মিলিমিটার ফিল্ম। সেই ফিল্ম নিয়েই চলল চর্চা।
নটসূর্য। অহীন্দ্র চৌধুরীর ছবিটি তুলেছিলেন পরিমল গোস্বামী।
এই ঘটনা কি নিছকই অহীন্দ্র চৌধুরী নামক এক খ্যাতনামা নটের ব্যক্তিজীবন? উত্তর একই সঙ্গে হ্যাঁ, এবং না। তাঁর ব্যক্তিসত্তা তো এখানে উপস্থিত, নিঃসন্দেহে, কিন্তু তদানীন্তন কলকাতার সংস্কৃতি-জীবনের একটি নির্ভুল ছবিও কি ধরা পড়ছে না এতে? বোঝা যাচ্ছে না কি, কী ভাবে অভিনয়কর্মের বিভিন্ন দিকের সন্ধান রাখতে চাইছেন অহীন্দ্র চৌধুরী স্বয়ং?
অভিনেতার এই বহুকৌণিক বিস্তার, ব্যক্তিগত ভাবে, আমাকে খুবই আকর্ষণ করে। কণ্ঠস্বর নির্মাণ থেকে শুরু করে শারীরিক কসরত, তার সঙ্গে বুদ্ধির চর্চা, এই ত্রিবিধ দিকেই অগ্রসর হওয়া প্রয়োজন। অহীন্দ্র চৌধুরী তাঁর সাধ্যমতো সেই কাজটি করেছিলেন। সেই বিবরণ পাঠ করতে করতে শ্রদ্ধার উদ্রেক হয়।
আক্ষেপ হয় শুধু, এমন বিচিত্রগামী স্মৃতি কেন আরও একটু সুগ্রথিত হল না! মনের চলন স্বভাবতই বিচিত্র, কিন্তু লেখনীতে তাকে ধরার সময় খানিকটা রাশ টেনে রাখা জরুরি। বিশেষত, স্মৃতির ক্ষেত্রে তা আরও বেশি জরুরি। একটি সূত্রে টান পড়লে আরও পাঁচটি কথা ভেসে আসে। তার চারটিই হয়তো, সেই বিশেষ প্রসঙ্গে, উল্লেখের দাবি রাখে না। ফলে, স্মৃতিচারণিক ঈষৎ নির্মম হবেন, এটাই রচনার পক্ষে প্রত্যাশিত!
অহীন্দ্র চৌধুরী ততটা নির্মমতা দেখাননি, ফলে গ্রন্থটির চাল যথেষ্ট আলগা, রচনা তথ্যবহুল, কিন্তু বাঁধুনিটি অনুপস্থিত। অহীন্দ্র মোটামুটি ভাবে কালানুক্রমের একটি ধারা মেনে চলতে চেয়েছেন বটে, কিন্তু তার মধ্যেও সময়ের ধারা সরলরেখায় চলেনি। স্মৃতিকথার ক্ষেত্রে এই কালানুক্রমটি রাখা জরুরি বলেই মনে হয়, কিন্তু তাতেও ততটা অসুবিধা হওয়ার কথা নয়, হত-ও না, যদি পাঠ্যবস্তুটির প্রসাদগুণটি অক্ষুণ্ণ থাকত!
সমস্যা এই যে লেখক যেন তাঁর দিনপঞ্জির পৃষ্ঠাটিকেই সরাসরি এনে ফেলেছেন গ্রন্থের মলাটের ভিতর। গ্রন্থের দ্বিতীয় খণ্ডে ২৫৪ পৃষ্ঠা থেকে কয়েকটি বাক্য উদ্ধৃত করি। যে অনুক্রমে বাক্যগুলি গ্রন্থভুক্ত, সরাসরি সেই অনুক্রমই বজায় রাখছি উদ্ধৃতিতে। ‘নাটকের ফলাফলই প্রমাণ করল রিজিয়ার অভিনয় ব্যর্থ হয়নি। এই নাটকে আমার ভূমিকা ছিল বক্তিয়ারের। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চতুর্থ বার্ষিকী ছিল তেসরা নভেম্বর। এই দিনই মিত্রশক্তিবাহিনী ইটালির মাটিতে অবতরণ করল। আবার এই তারিখেই স্টারে মহারাজা নন্দকুমারের ৫০ তম অভিনয় রজনির স্মারক-উৎসব অনুষ্ঠিত হল।’ এই ভাবেই নানাবিধ প্রসঙ্গে, অনেক সময়ই অকারণ কিছু শাখা-প্রশাখায় বয়ে গিয়েছে বাক্যস্রোত। তাতে রচনার পাঠ্যগুণ ক্ষুণ্ণ হয়েছে অনেকটাই।
অবশ্য, এই ত্রুটির ফলে এই সুবৃহৎ, সুমুদ্রিত গ্রন্থটির প্রকৃত মহিমা ঢাকা পড়ে না। কলকাতার রঙ্গালয়ের ইতিহাস, কলকাতার নগর-সংস্কৃতির ইতিহাস পুনর্দর্শনের ক্ষেত্রে এই বইটি অতীব মূল্যবান। অপরিহার্য বলা চলে। ‘দেশ’ পত্রিকায় দেড় বছরের অধিক কাল সপ্তাহে সপ্তাহে প্রকাশিত হয়েছিল এই রচনা। বেশ কিছু দুর্লভ ছবি-সহ তাকে গ্রন্থবদ্ধ করার জন্য সপ্তর্ষি প্রকাশনেরও বহুতর সাধুবাদ প্রাপ্য।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.