নয়াগ্রামে সেতুর কাজে বাধা, আঙুল তৃণমূলের দিকে
মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্ন-প্রকল্পেও থাবা বসিয়েছে সিন্ডিকেট
যে প্রকল্পের বাস্তবায়নে স্বয়ং মুখ্যমন্ত্রী ‘বিশেষ নজর’ দিয়েছেন, সেখানেই এ বার ‘সিন্ডিকেট’-এর জুলুমবাজির অভিযোগ! এমনকী, নির্মাণকাজের মালপত্র ও যন্ত্রপাতি সরবরাহের বরাত পাওয়ার দাবিতে সরকারি নির্মাণসংস্থার ইঞ্জিনিয়ারদের হেনস্থা করার অভিযোগও উঠল সেখানে।
এবং এ ক্ষেত্রে আঙুল মুখ্যমন্ত্রীরই দলের স্থানীয় কিছু কর্মী-সমর্থকের দিকে।
গত ১০ মে ঘটনাটি ঘটেছে পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রামে। তার জেরে সুবর্ণরেখার উপরে ওই সেতু নির্মাণের দায়িত্বপ্রাপ্ত সংস্থা ম্যাকিনটশ বার্ন-এর কর্মীরা ভয়ে এলাকা ছেড়ে পালিয়ে যান। পরে তৃণমূল রাজ্য নেতৃত্বের হস্তক্ষেপে সেতু তৈরির আনুষঙ্গিক কাজ শুরু হলেও আতঙ্ক রয়েই গিয়েছে। পুলিশকে বলা হয়েছে পরিস্থিতিতে সর্বক্ষণ নজর রাখতে।
গত ১২ জানুয়ারি ‘জঙ্গলমহল উৎসবে’ ঝাড়গ্রামে এসে মুখ্যমন্ত্রী ঘোষণা করেছিলেন, প্রস্তাবিত কেশিয়াড়ি-নয়াগ্রাম সেতুর কাজ দ্রুত এগোচ্ছে, টেন্ডারও হয়ে গিয়েছে। মমতার অনুরোধে সে দিন মুখ্যসচিব সমর ঘোষও হাতে মাইক্রোফোন নিয়ে জঙ্গলমহলের মানুষকে সেই ‘তথ্য’ জানিয়েছিলেন। শেষ পর্যন্ত অবশ্য রাজ্য সরকার টেন্ডার ডাকেনি। তার বদলে পূর্ত ও অর্থ দফতরের সুপারিশ মেনে গত ২৩ এপ্রিল ওই ভসরাঘাট সেতু তৈরির বরাত দেওয়া হয় ম্যাকিনটশ বার্ন-কে।
আর সেই কাজ শুরু করতে গিয়ে গোড়াতেই ধাক্কা খেল সরকারি সংস্থাটি। কী রকম?
পশ্চিম মেদিনীপুরের জেলাশাসক সুরেন্দ্র গুপ্তকে লেখা চিঠিতে ম্যাকিনটশ বার্নের ম্যানেজিং ডিরেক্টর স্বপন সেন বলেছেন, সে দিন সকালে হঠাৎ এক দল লোক সাইটে ঢুকে সব কাজকর্ম জবরদস্তি বন্ধ করে দেয়। তারা দাবি করে, সেতু তৈরির যাবতীয় উপকরণ তাদের থেকে নিতে হবে। অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতিগুলোও তারা সরবরাহ করবে, বিনিময়ে মোটা ভাড়া দিতে হবে। সংস্থা-কর্তৃপক্ষের অভিযোগ: প্রস্তাবে রাজি না-হওয়ায় দুষ্কৃতীরা কয়েক জন ইঞ্জিনিয়ারকে নিগ্রহ করে। প্রাণ বাঁচাতে অন্য কর্মীরা সাইট ছেড়ে পালিয়ে যান। পরে র্যাফ নামিয়ে পরিস্থিতি সামলান জেলার পুলিশকর্তারা।
সুবর্ণরেখার উপরে এখানেই হওয়ার কথা কেশিয়াড়ি-নয়াগ্রাম সেতু। ফাইল চিত্র।
বস্তুত এমনটা যে ঘটতে পারে, তা আঁচ করে ম্যাকিনটশের কর্তারা স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্বের সঙ্গে একাধিক বার বৈঠক করেছিলেন বলে সংস্থা-কর্তৃপক্ষের দাবি। নয়াগ্রামের তৃণমূল বিধায়ক দুলাল মুর্মুও সেখানে ছিলেন। ডিএম-কে লেখা চিঠিতে স্বপনবাবুর বক্তব্য: মে-র গোড়ায় ওই আলোচনায় সংস্থার তরফে আশ্বাস দেওয়া হয়েছিল, নির্মাণের ইট-বালি যতটা সম্ভব স্থানীয় সরবরাহকারীদের থেকে নেওয়া হবে। শুধু তা-ই নয়, মজুর জোগানের বরাত তখনই তাদের পাকাপাকি ভাবে দিয়ে দেওয়া হয়। সংস্থা কর্তৃপক্ষ ওই ‘কন্ট্র্যাক্টর’দের এ-ও আশ্বাস দিয়েছিলেন, কী কী যন্ত্র তাঁদের পক্ষে সরবরাহ করা সম্ভব, ইঞ্জিনিয়ারেরা তা খতিয়ে দেখে রিপোর্ট দিলে সেই মতো তাঁদের ওই বরাতও দেওয়া হবে।
এত কিছুর পরেও ১০ তারিখের ‘হামলা’র জেরে আতঙ্কিত হয়ে পড়েছেন নয়াগ্রামে কর্মরত ম্যাকিনটশের ইঞ্জিনিয়ার-কর্মীরা। সংস্থার এক আধিকারিকের আক্ষেপ, “রাজ্যে এত বড় সেতু (১.৩ কিলোমিটার) আমরা আগে বানাইনি। এটা আমাদের কাছে চ্যালেঞ্জ। কিন্তু গোড়াতেই যে ভাবে প্রতি পদে বাধা আসছে, তাতে নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ করা কঠিন হয়ে পড়ছে।” প্রশাসন কী করছে?
প্রশ্ন শুনে জেলাশাসক সুরেন্দ্র গুপ্তের পাল্টা প্রশ্ন, “ম্যাকিনটশ বার্ন কি পুলিশে এফআইআর করেছে?” কিন্তু আপনাকে তো চিঠি দিয়ে জানিয়েছে? ডিএমের জবাব, “তা হলে ওদেরই জিজ্ঞেস করুন। এমন কোনও ঘটনা আমার জানা নেই।” রাজ্য পুলিশের এক কর্তা অবশ্য বলেছেন, “আমরা নজর রাখছি। জেলা গোয়েন্দা-পুলিশকেও নিয়ম করে খবর পাঠাতে বলা হয়েছে। প্রয়োজনে ওখানে দিনভর পুলিশ-পাহারা দেওয়া হবে।”
কিন্তু এ ভাবে কি কাজ চালিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব? মহাকরণ-সূত্রের খবর: নয়াগ্রামে সেতুর স্তম্ভ বানাতে ম্যাকিনটশ এমন যন্ত্র এনেছে, যা মাটিতে একশো ফুট গভীর গর্ত করে নিজেই সিমেন্ট ঢেলে ঢালাই করে দেবে। যন্ত্রটির মাসিক ভাড়া ১৩ লক্ষ টাকা। সরকারি ইঞ্জিনিয়ারদের বক্তব্য, আধুনিক প্রযুক্তির সুবাদে এমন বড় প্রকল্পে মানুষের চেয়ে যন্ত্র অনেক বেশি কার্যকরী। তাই কাজ দ্রুত শেষ করতে এমন বেশ কিছু যন্ত্র আনতে হবে, যেগুলো কোনও মতেই স্থানীয় স্তরে ভাড়া পাওয়া সম্ভব নয়। “তা হলে সেগুলোর বরাত নয়াগ্রামের ‘কন্ট্র্যাক্টরদের’ দেওয়া যাবে কী ভাবে? যেখানে প্রায় দেড় লক্ষ টন সিমেন্ট লাগবে, সেখানে কী ভাবে ভরসা করব কুচো সিন্ডিকেটকে?” প্রশ্ন তুলেছেন ইঞ্জিনিয়ারেরা।
এখানেই শেষ নয়। মহাকরণে অভিযোগ এসেছে, নয়াচরের সাইটে মালবোঝাই লরিতে ‘কর’ বসিয়েছে সিন্ডিকেট। লরিপিছু ৫০০-১০০০ টাকা আদায় করা হচ্ছে। মজুর আবাসনে নলকূপ, মায় মজুরদের খাটেরও বরাতও তাদের দিতে বাধ্য হয়েছেন ম্যাকিনটশ-কর্তৃপক্ষ। এবং বিধায়ক দুলাল মুর্মুরই ঘনিষ্ঠ কিছু লোক এই ‘জুলুমবাজি’ চালাচ্ছে বলে পুলিশ-প্রশাসন সূত্রের খবর। বিধায়ক কী বলছেন?
দুলালবাবু অবশ্য অভিযোগ মানতে চাননি। তাঁর বক্তব্য, “এলাকার কিছু ছেলে এ সব করছে।” কারা তারা?
সরাসরি জবাব এড়িয়ে বিধায়ক বলেন, “একটা সমস্যা হয়েছিল। এখন মিটে গিয়েছে। দ্রুত গতিতে কাজ চলছে।” তবে স্থানীয় তৃণমূল নেতৃত্ব যে ইতিমধ্যে সেতুর কাজে নিযুক্ত মজুরদের নিয়ে দলীয় ব্যানারে শ্রমিক সংগঠন বানিয়ে ফেলেছেন, বিধায়ক তা জানাতে ভোলেননি।
মহাকরণ-সূত্রের খবর: নয়াগ্রামে সেতুনির্মাণে বিঘ্নের কথা প্রথম জানানো হয়েছিল পূর্তমন্ত্রী সুদর্শন ঘোষদস্তিদারকে। তিনি জানান তৃণমূলের রাজ্য সভাপতি সুব্রত বক্সিকে। সুদর্শনবাবু বলেন, “এটা মুখ্যমন্ত্রীর স্বপ্ন-প্রকল্প। কোনও বাধাই থাকবে না। সব উড়ে যাবে। এ মাসের শেষে আমি নিজে যাব নয়াগ্রামে।” আর দুলালবাবু বলছেন, “সুব্রতবাবুর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে। সুদর্শনবাবুও ফোন করেছিলেন।” তার পরেও অবশ্য নয়াগ্রামে ‘দাবি-দাওয়া’ থেমে নেই। অন্তত জেলা প্রশাসন-সূত্রে তেমনই খবর।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.