ব্যাগ গুছিয়ে... রূপসী কিয়ংজু
বুজ পাহাড় ও নীল সমুদ্রে ঘেরা ছোট্ট দেশটিকে ভরিয়ে রেখেছে গ্রীষ্ম, হেমন্ত, শীত, বসন্ত এই চার ঋতুর বর্ণবৈচিত্র।
ইতিহাস বলে খ্রিস্টপূর্ব ৩০,০০০ বছর আগে মধ্য এশিয়ার যাযাবর জাতির মাধ্যমে যে সভ্যতার সূচনা তা পূর্ণতা পায় সপ্তম শতাব্দীর শীলা সাম্রাজ্যের রাজত্বকালে। ক্রমে ক্রমে সাম্রাজ্যের রাজধানী কিয়ংজু স্থাপত্য, শিল্প ও সাহিত্যের পীঠস্থান হয়ে ওঠে। বর্তমান রাজধানী সোল (সিয়ল) থেকে দক্ষিণ-পূর্বে অবস্থিত এই স্থানটির দূরত্ব ৩২৬ কিলোমিটার।
কিয়ংজুকে রাজস্থানের ‘পিঙ্কসিটির’ সঙ্গে তুলনা করা যায়। শহরের প্রবেশদ্বারটি প্যাগোডা আকৃতির। হাতে গোনা কয়েকটি বহুতল ছাড়া শহরের প্রতিটি বাড়ি, দোকানবাজার, রেস্তোরাঁ এমনকী পেট্রোল পাম্পগুলির ছাদও প্যাগোডা আকৃতির। শহরের মাঝে এ দিকে ও দিকে বিস্তীর্ণ সবুজ প্রান্তরের মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা উঁচু উঁচু ঢিবিগুলি বিস্ময়ের সৃষ্টি করে। এগুলি রাজাদের সমাধি। তাই কিয়ংজুকে বলা হয় ‘সিটি অব টুম্ব’ (ঢিবির শহর)। এই শহরকে ‘মিউজিয়াম উইদাউট ওয়াল’ও বলা হয়।
শহরটির প্রধান দ্রষ্টব্য স্থানগুলি হল প্রাচীন সমাধিক্ষেত্র ‘তুমুলি পার্ক’, মানমন্দির ‘চিয়মসিউং ডে’, বুদ্ধমূর্তি সাকগুরাম গ্রোটো, ‘বুলগুকসা’ বৌদ্ধ মন্দির। ইয়োরোপের রোম বা ভারতের রাজস্থানের মতো দক্ষিণ কোরিয়ার এই শহরটি পৃথিবীর ইতিহাসে জায়গা করে নিয়েছে। যে কোনও ঋতুতেই কিয়ংজু অপরূপা হয়ে ওঠে। হেমন্তের লাল হলুদ পাতা অতি প্রাচীন বুলগুকসা মন্দিরকে হোলির রঙে ভরিয়ে দেয়। শীতে বরফের শুভ্রতায় এই মন্দিরটি স্বর্গীয় রূপ পায়। বসন্তের শুরুতে চেরি ফুল, বমুন লেক, সমাধিক্ষেত্রগুলিকে নতুন রূপে সাজিয়ে তোলে। জুলাই মাসে ঐতিহাসিক ‘অ্যানপ্জি পন্ড’ লাল রঙের পদ্ম ফুলে ভরে যায়।
‘তুমুলি পাক’ দিয়ে সফর শুরু। শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বিশাল প্রাচীর ঘেরা তুমুলি পার্কে টিকিট কেটে ঢুকতে হবে। এই সবুজ প্রাঙ্গণেই রয়েছে শীলা সাম্রাজ্যের সম্রাট ও তাদের পরিবারের কুড়িটি সমাধিক্ষেত্র। এখানকার জাদুঘরে প্রতিটি সমাধিক্ষেত্র থেকে প্রাপ্ত ধনসম্পদ রক্ষিত আছে। পিরামিড না দেখে থাকলে এই ঢিবিগুলি দেখে ভালই চমক লাগবে। ‘চিউমাচাং’ টুম্বটি দর্শকদের জন্য খুলে দেওয়া হয়েছে। পঞ্চম শতাব্দীতে তেরো মিটার উচ্চ ও সাতচল্লিশ মিটার ব্যাসার্ধযুক্ত এই বিশাল সমাধিক্ষেত্র তৈরি হয়েছিল। এখানে প্রাপ্ত স্বর্ণমুকুট, গহনা, মাটির পাত্র, অস্ত্রশস্ত্র সবই দর্শকেরা দেখতে পাবেন।
‘তুমুলি পার্ক’ থেকে পায়ে হেঁটে দেখে নেওয়া যাবে ‘চিয়মসিউং ডে’ মান মন্দির। ৬৩২ সালে তৈরি এই মানমন্দিরটির গঠনশৈলী দৃষ্টি আকর্ষণ করে। মানমন্দির ছাড়িয়ে পায়ে হাঁটা পথ চলে গিয়েছে দেড় হাজার বছরের পুরাতন শীলা সাম্রাজ্যের স্মৃতিরক্ষার্থে রাজা ‘মুনমু’র তৈরি আনন্দ উদ্যান। উদ্যান-সংলগ্ন জলাশয় ‘আনপজি পন্ড’ থেকে উদ্ধার হওয়া প্রচুর ধ্বংসাবশেষ কিয়ংজুর জাতীয় জাদুঘরে রাখা আছে। বাগানে রক্ষিত ‘এমিলি বেল’ এর কথা না বললেই নয়। ছোটবেলাতে আমরা এই ‘এমিলি বেল’-এর গল্প সবাই পড়েছি। এটি পৃথিবীর সব থেকে বড় ঘণ্টাগুলির একটি। কথিত আছে, ঘণ্টাটি যত বারই তৈরি হচ্ছিল তা যথাযথ ধ্বনিতে বাজছিল না। এক বৌদ্ধ সন্ন্যাসীর স্বপ্নাদেশ অনুযায়ী গলিত ধাতুর মধ্যে একটি বাচ্চাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তার পর ঘণ্টাটি তৈরি করা হয়। তাই যখন এই ঘণ্টাটি বাজে তখন যেন বাচ্চাটির ‘মা মা’ বলে আর্তস্বরই ধ্বনিত হয়।
রাতের কিয়ংজু অপূর্ব আলোকশয্যায় রহস্যময় হয়ে ওঠে। ‘আনপজি পন্ডে’ প্যাভিলিয়ানের আলোকিত প্রতিফলন না দেখে ফিরবেন না কিন্তু। শহরের দক্ষিণপূর্বে ‘বুলগুকসা’ মন্দির। পাহাড়ের গা বেয়ে ঘুরে ঘুরে রাস্তা উঠে গিয়েছে। চারি দিকে নেপল গাছের সারি। ৫২৮ খ্রিস্টাব্দে এই মন্দিরের নির্মাণ কাজ আরম্ভ হলেও ৭৭৪-এ তা সমাপ্ত হয়। ‘বুলগুকসা’ মন্দিরের ঘণ্টা, করিডরের গঠন বৈচিত্র, কচ্ছপের পিঠের ওপর ড্রাম, প্রবেশদ্বারের মূর্তি সবই শীলা সাম্রাজ্যের প্রতীক হয়ে আছে। প্রধান মন্দিরে ১.৭৭ মিটার দীঘর্র্ ব্রোঞ্জের বুদ্ধমূর্তির প্রশান্ত ভাব মনকে ছুঁয়ে যায়। ১৫৯৩-এ জাপানিদের আক্রমণে ধ্বংসপ্রান্ত এই মন্দিরের পুনরুদ্ধারের কাজ ১৯২৭-এ শেষ হয়।
মন্দিরের গা বেয়ে পাহাড়ি রাস্তা আরও পূর্বে ‘সাকোগুরাম গ্রাটো’র দিকে চলে গিয়েছে। এখানে শাক্যমুনি বুদ্ধর উপবিষ্ট প্রস্তরমূর্তি শোভা পাচ্ছে। বুদ্ধদেব পূর্বে জাপান সমুদ্রের দিকে তাঁর দৃষ্টি প্রসারিত করে আছেন।
শহরে ফেরার পথে ‘বমুন লেক’-এ সূর্যাস্তের লাল আভা দেখে মন ভরে ওঠে। এপ্রিল মাসে লেকের চারি দিক সাদা ও গোলাপি চেরিফুলে ঢাকা পড়ে যায়। লেকে নৌকাবিহার সেরে যাওয়া যায় রাজা ‘মিইউল’ ও জেনারেল ‘কিম ইউ শিন’-এর সমাধিক্ষেত্রে। পূর্ব দিকে সমুদ্রের কোল ঘেঁষে রাজা ‘মুনমু’র জলের তলার সমাধিক্ষেত্র। ভাটার টানে জল সরে গেলে সমাধিক্ষেত্রটি উপর থেকে পরিষ্কার দেখা যায়। রাজা ‘মুনমু’র শেষ ইচ্ছা অনুযায়ী তাঁর দেহভস্ম এখানে সমাধিস্থ করা হয়। তিনি বিশ্বাস করতেন যে তাঁর সমাধিক্ষেত্র জাপানিদের আক্রমণের হাত থেকে কোরিয়ার উপকূল অঞ্চলকে চিরকাল রক্ষা করে যাবে।
রাজধানী সোল-এ দেখার মতো রাজপ্রাসাদ, মন্দির, উদ্যান, জাদুঘরের সঙ্গে সঙ্গে আবার ঝাঁচকচকে অত্যাধুনিক শপিংমল, অ্যামিউজমেন্ট পার্ক আছে। কলকাতা থেকে যাতায়াতের খরচটা একটু বেশি। তাই সঙ্গে জাপান বা বেজিংয়ে বেড়ানোর পরিকল্পনা করলে ভাল হয়। কোরিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর বুসান থেকে ফেরি বোটে সাড়ে তিন ঘণ্টায় জাপানের ফুকুওকাতে পৌঁছে যাওয়া যাবে। আবার এই এয়ারপোর্ট থেকে প্লেনে পৌনে দু’ঘণ্টায় বেজিং পৌঁছানো যাবে। তবে সব ভিসাই ভারত থেকে করে আনতে হবে।




অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.