চিলতে টিনের শেডের নীচে মজুত করা ঠাসাঠাসি গ্যাস সিলিন্ডার। যন্ত্রের মাধ্যমে সেই সব সিলিন্ডার থেকেই ‘কুকিং এলপিজি’-তে ভরে যাচ্ছে অটোর গ্যাসব্যাঙ্ক। খাস কলকাতা থেকে শুরু করে শহরতলি সর্বত্র ‘চোরাই’ গাসের এই ‘কুটির-শিল্প’-এর রমরমা।
সম্প্রতি কলকাতা পুলিশের এনফোর্সমেন্ট শাখার অভিযানে এমনই একটি চোরাই-চক্রের হদিস মিলেছে দক্ষিণ কলকাতার কালিকাপুরে। দু’জন অটোচালক-সহ ধরাও পড়েছে পাঁচ জন। কাছেই চৌবাগা, গড়িয়া, কামালগাজি, সোনারপুরেও এমন চক্রের রমরমা কারবার বলে পুলিশের কাছে খবর। কিন্তু কালিকাপুরের মাদুরদহের ঠেকে ধর-পাকড়ের সঙ্গেসঙ্গেই সাময়িক ভাবে ওই তল্লাটে পাততাড়ি গুটিয়ে ‘পাখি’ পালিয়েছে। বেশ কয়েকটি জায়গায় অভিযান চালিয়েও খালি হাতে ফিরেছে পুলিশ।
গৃহস্থের রান্নাঘরে ব্যবহার্য গ্যাসের জন্য ভর্তুকি দিয়ে থাকে কেন্দ্রীয় সরকার। সেই গ্যাস কী ভাবে পৌঁছে যাচ্ছে চোরাই-চক্রের কাছে? তদন্তে নেমে এ বার এই পদ্ধতিটি হাতে-কলমে টের পেয়েছে পুলিশ। এবং এ যাত্রা সরাসরি ইন্ডিয়ান অয়েল সংস্থার গ্যাস সিলিন্ডার সরবরাহকারীদের সঙ্গে চোরাই-চক্রের পাণ্ডাদের যোগসাজশেরও প্রমাণ মিলেছে। তবে
রান্নার এলপিজি অটোর গ্যাসট্যাঙ্কে ভর্তি করার কাজটা যারা করছে, তাদের কয়েক জনকে গ্রেফতার করলেও রান্নার গ্যাস সরবরাহকারীদের কাউকে এখনও ধরতে পারেনি পুলিশ। |
লালবাজারের এক কর্তার কথায়, “ইন্ডিয়ান অয়েল সংস্থার হয়ে রান্নার গ্যাস সরবরাহ করার ডেলিভারিম্যানদের কেউ কেউ চুরি-চক্রে জড়িত। ভবিষ্যতে ওই সংস্থাকে চিঠি লিখে সর্ষের মধ্যে ভূতের ব্যাপারে সাবধান করে দেওয়া হবে।” ‘ইন্ডিয়ান অয়েল কর্পোরেশন’-এর চিফ জেনারেল ম্যানেজার (এলপিজি) অভিজিৎ দে স্বীকার করেন, “রান্নার গ্যাসের ক্ষেত্রে অল্প কিছু সিলিন্ডারের অপব্যবহার ঠেকানো যায়নি। তবে শতকরা পাঁচ থেকে ১০ ভাগ সিলিন্ডারে এই গোলমাল।” তাঁর দাবি, “গ্রাহকদের রান্নার গ্যাস সরবরাহের পদ্ধতিতে আরও স্বচ্ছতা আনার চেষ্টা চলছে। ইউআইডি কার্ড বা স্মার্ট কার্ডের মাধ্যমে রান্নার গ্যাস সরবরাহের তোড়জোড় চলছে। এই প্রক্রিয়া শেষ হলে রান্নার গ্যাস চোরা পথে পাচার বন্ধ করা সম্ভব।”
ইবি সূত্রের খবর, গৃহস্থের জন্য রান্নার গ্যাসের ন্যূনতম দামের (৪০৫ টাকা) থেকে অবশ্য কিছুটা বেশি দামে (৫৫০ টাকা) এক-একটি সিলিন্ডার কিনে অটোয় ‘রিফিল’ করে চোরাই-চক্র। ধৃত অটোচালকেরা পুলিশকে জানিয়েছেন, তাঁরা কেজি পিছু ৬০ টাকা দরে এই রান্নার গ্যাস কিনছেন। সাধারণত এক সঙ্গে ৮ কেজি গ্যাস কিনলেই তাঁদের কাজ চলে। কিন্তু অটো এলপিজি-র দাম এর থেকে কিছুটা কম (কেজি পিছু ৫৩ টাকা)। কিন্তু অটো চালাতে ১২-১৩ কেজি অটো এলপিজি-র দরকার পড়ে। অর্থাৎ, রান্নার গ্যাসেই অটোচালকদের ‘সাশ্রয়’। এ ছাড়া, পেট্রোল-পাম্পে গিয়ে অটোর এলপিজি সংগ্রহ করাটাও ঢের সময়সাপেক্ষ। কিন্তু বিশেষজ্ঞদের মতে, অটোয় রান্নার গ্যাস ব্যবহার করলে অনেক বেশি কার্বন ছড়িয়ে দূষণ বাড়ে।
ইবি-র হাতে ধৃত দুই অটোচালক মহম্মদ আসলাম ও জিতু বৈরাগী ছাড়া রয়েছে ‘রিফিলম্যান’ সঞ্জয় রায়। কার্তিক দাস ও মৃত্যুঞ্জয় দে নামে দু’জনকে সহযোগী হিসেবে কাজে লাগিয়েছিল সঞ্জয়। গত মঙ্গলবার অটোয় গ্যাস ভরার সময়ে হাতেনাতে ধরা পড়া এই অভিযুক্তেরা এখন জামিন-অযোগ্য ধারায় পুলিশ-হাজতে। তবে চক্রটির সঙ্গে জড়িত রান্নার গ্যাসের ডেলিভারিম্যানদের হদিস এখনও পায়নি পুলিশ। পরিবহণ দফতরের পরামর্শদাতা তথা দূষণ বিশেষজ্ঞ সোমেন্দ্রমোহন ঘোষের মতে, “এই চক্রটি হিমশৈলের চূড়ামাত্র। বেশির ভাগ অটোই চোরাপথের রান্নার গ্যাসের উপরে নির্ভরশীল।” |