জন মেনার্ড কেইনস-এর গুরুত্ব ফুরাইবার নহে। দীর্ঘমেয়াদে সব ঠিক হইয়া যাইবে, ধ্রুপদী অর্থনীতির সাধকদের এমন একটি ঋষিসুলভ আশ্বাসের উত্তরে তিনি বলিয়াছিলেন, ‘দীর্ঘমেয়াদে আমরা সকলেই মৃত’। মন্তব্যটি গত শতকের কুড়ির দশকের। প্রায় নব্বই বৎসর পরেও, বর্তমানের গ্রিক অর্থনৈতিক সংকটের প্রেক্ষিতে, কথাটি আশ্চর্য রকম সত্য। গ্রিস যে শর্তে আন্তর্জাতিক ঋণ পাইয়াছে, সেই শর্তগুলির অর্থনৈতিক পরিভাষার খোলস সরাইয়া রাখিলে যাহা দাঁড়ায়, তাহা এই রকম আগের কয়েক বৎসর তোমরা দেদার ফুর্তি করিয়াছ, অতএব এখন পেটে গামছা বাঁধিয়া কৃচ্ছ্রসাধন করো। মুশকিল হইল, পূর্ব বিলাসিতার স্মৃতি বা আন্তর্জাতিক সদুপদেশ, কোনওটিতেই পেট ভরে না। তাহার জন্য অর্থনীতিকে আর্থিক ভাবে সক্রিয় থাকিতে হয়, বৃদ্ধির পথে চলিতে হয়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং আন্তর্জাতিক অর্থ ভাণ্ডার যে পরিমাণ কৃচ্ছ্রসাধনের বিধান দিয়াছে, তাহাতে সরকারের ব্যয় করিবার ক্ষমতা বিপুল ভাবে কমিয়াছে, সাধারণ্যের হাতে অর্থ নাই, ফলে বাজারে চাহিদা নাই। অর্থনীতি ধুঁকিতেছে। পাপস্খালনের এই ঋষিসুলভ পন্থাটি বেশ কয়েক বৎসর অনুসৃত হইলে গ্রিসের পুরাতন ভ্রান্তিগুলি সংশোধিত হইবে, তাহা ঠিক। কিন্তু, সেই দীর্ঘমেয়াদে কেইনস-এর ভবিষ্যৎবাণীটি অমোঘ হইবার আশঙ্কা। গ্রিসবাসী ব্যয়সংকোচের দাপটে বিপন্ন, বিক্ষুব্ধ। সন্ত্রস্তও। কিছু দিন পূর্বে গ্রিসে যে সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হইল, তাহার ফলে জনমানসের প্রতিফলন হইয়াছে। কোনও দলই সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় নাই। কিন্তু, যে দল ব্যয়সংকোচের বিরুদ্ধে যত সরব, সেই দলের দিকে মানুষের সমর্থনও তত বেশি। এই দফার নির্বাচনে কেহ সরকার গড়িতে পারে নাই। ফলে, আগামী মাসে ফের নির্বাচন। আশঙ্কা, তাহাতে যাহারা জিতিবে, তাহারা ব্যয়সংকোচের সম্পূর্ণ বিপক্ষে থাকিবে।
পরিস্থিতিটি মারাত্মক। গ্রিসের নূতন সরকার যদি রাজনৈতিক ভাবে ব্যয়সংকোচের বিরোধিতা করিতে বাধ্য হয়, তবে আন্তর্জাতিক ঋণ পরিশোধের প্রক্রিয়াটি বিশ বাঁও জলে। তাহার প্রায় অবশ্যম্ভাবী ফল, গ্রিস ইউরোপীয় ইউনিয়ন ত্যাগ করিবে। একটি হিসাব বলিতেছে, গ্রিস এমন ভাবে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ছাড়িলে ইউরোপীয় অর্থনীতির মোট এক লক্ষ কোটি ডলার ক্ষতি হইবে। বিপুল অঙ্ক। গ্রিস যদি ইউরো ছাড়িয়া দ্রাখমায় ফিরিয়া যায়, এবং ব্যাপক হারে মুদ্রার অবমূল্যায়ন করে, তাহাতে গ্রিসের কোনও লাভ হইবে কি? অর্থনীতির পূর্ব ইতিহাস মানিলে বলিতে হয়, লোকসান অবধারিত নহে। ১৯৯০-এর দশকের আর্থিক সংকটের পরে যে দেশগুলি বিপুল অবমূল্যায়নে বাধ্য হইয়াছিল, তাহাদের বৃদ্ধির পথে ফিরিতে বেশি সময় লাগে নাই। তাহাদের ক্ষেত্রে রফতানি একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা লইয়াছিল। কিন্তু, গ্রিস যদি ইউরো ত্যাগ করে, তাহার তাৎক্ষণিক ধাক্কা জোরদার হইবে। বস্তুত স্পেন বা পর্তুগালের ন্যায় মন্দা-পীড়িত অর্থনীতি গ্রিসের অনুসারী হইতে পারে। তাহাতে ইউরো অঞ্চলের অর্থনীতির ছবি কী দাঁড়াইবে, এখনও অনুমান করাই কঠিন।
একটি কথা স্পষ্ট ভাবে বলা প্রয়োজন গ্রিস বা ইউরোপের অন্যান্য ঋণগ্রস্ত অর্থনীতিকে যথার্থ রাজস্ব নীতির পথে ফিরিতেই হইবে। রাজকোষ ঘাটতি কমাইতে হইবে। তাহার অর্থ এক দিকে ব্যয়সংকোচ, অন্য দিকে রাজস্ব বৃদ্ধি। কিন্তু, রাজস্ব পরিস্থিতি সংশোধনের সময়সূচি কী হইবে, তাহাই প্রশ্ন। অ্যাঞ্জেলা মর্কেল এবং তাঁহার দোসর, ফ্রান্সের সদ্য-প্রাক্তন প্রেসিডেন্ট নিকোলাস সারকোজি যে কঠোরতার সাধক, তাহা আদৌ সুস্থায়ী হইতে পারে কি না, বিশদ ভাবা প্রয়োজন। বরং, ফ্রান্সের নূতন প্রেসিডেন্ট ফ্রঁসোয়া ওলাঁদ যে কথা বলিতেছেন, তাহা প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলিয়াছেন, আর্থিক বৃদ্ধির হার বাড়াইবার মাধ্যমেই ইউরোপ সুস্বাস্থ্যে ফিরিতে পারে। আয় বাড়িলে রাজস্বের পরিমাণও বাড়িবে। অন্য দিকে, ব্যয়সংকোচের পথে নিশ্চিত, কিন্তু ছোট, পদক্ষেপ প্রয়োজন। ইউরোপের স্বাস্থ্যভঙ্গ এক দিনে হয় নাই। এক ঝটকায় তাহাকে স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরাইয়া দেওয়াও সম্ভব নহে। বেশি চাপ দিলে তাহার কী প্রতিক্রিয়া হইতে পারে, গ্রিসে টের পাওয়া যাইতেছে। অতঃপর, সাবধান হওয়াই বিধেয়। |