এ যেন নাকের বদলে নরুন!
রাজকোষের ঘাটতিতে রাশ টানতে জ্বালানি ও সার খাতে ভর্তুকি কমানোর সিদ্ধান্ত এখনও নিয়ে উঠতে পারেনি মনমোহন সরকার। বরং ফিরতে হচ্ছে পুরনো পথেই। ২০০৯ বা ২০১১-র মতোই ব্যয়সঙ্কোচের লক্ষ্যে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী ও আমলাদের বিদেশ সফরে কাটছাঁট করতে চলেছে সরকার। নিষেধাজ্ঞা জারি হতে চলেছে পাঁচতারা হোটেলে বৈঠক ও সম্মেলনের উপরেও। বৈঠক-সম্মেলন বাবদ মোট খরচও ১০ শতাংশ কমাতে বলা হচ্ছে। নিরাপত্তা বাহিনীর প্রয়োজন ছাড়া নতুন গাড়ি কেনাও বন্ধ হতে চলেছে। পরবতী পর্যায়ে প্রকল্প ধরে ধরে খরচ কমানোরও ভাবনা রয়েছে সরকারের।
কিন্তু সরকারের অন্দরমহলেই প্রশ্ন উঠছে, এই ব্যয়সঙ্কোচে কতটা লাভ হবে? কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখোপাধ্যায়ের বক্তব্য, আর্থিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকার যে সক্রিয়, সেই বার্তাটা অন্তত যাবে বিশ্বের কাছে। তবু যে প্রশ্নগুলি থেকে যাচ্ছে তা হল, দেশের অর্থনীতি ও মনমোহন সরকারের প্রশাসনিক নৈপুণ্য, সিদ্ধান্তগ্রহণে দ্বিধা নিয়ে শিল্পমহলে যে হতাশা তৈরি হয়েছে, শুধু ব্যয়সঙ্কোচ করেই কি তা দূর করা সম্ভব? আর্থিক বৃদ্ধির হার কি এতে বাড়বে? নাকি ডলারের তুলনায় টাকার দাম বাড়বে ব্যয়সঙ্কোচের ফলে?
অর্থনীতিবিদরাও বলছেন, ব্যয়সঙ্কোচ করে টাকার পতন ঠেকানো যাবে না। সেটা স্বীকার করছে অর্থ মন্ত্রকও। ডলারের তুলনায় টাকার দাম আজ আরও নেমে ৫৪.৯১ টাকায় পৌঁছেছে। বিদেশি মুদ্রার কারবারিরা মনে করছেন, ডলারের দাম ৫৫ টাকায় পৌঁছনো এখন শুধুমাত্র সময়ের অপেক্ষা। ডলারের দাম বেড়ে যাওয়ায়, আন্তর্জাতিক বাজারে অশোধিত তেলের দাম সামান্য কমলেও আমদানি খরচ মোটের উপর একই থাকছে। অর্থ মন্ত্রকের তরফে আজ লোকসভায় জানানো হয়েছে, ইউরো-সঙ্কটের ফলে লগ্নিকারীরা ডলারকেই বিনিময়ে নিরাপদ মাধ্যম বলে মনে করছেন। ফলে ডলারের চাহিদা বেড়েছে সরবরাহের তুলনায়। টাকার পতনের অন্যতম কারণ সেটাই। তার সঙ্গে যোগ হয়েছে কারেন্ট অ্যাকাউন্টের ঘাটতি। কমে গিয়েছে বিদেশি আর্থিক সংস্থাগুলির বিনিয়োগও। |
|
পূর্ণমন্ত্রী |
২০০৯-’১০ |
২০১০-’১১ |
২০১১-’১২ |
বিদেশ সফর |
৬১.১০ |
৩৭.১৭ |
৬৬১.৫৭ |
ঘরোয়া সফর |
৯.১৬ |
৬.৯৩ |
৫.৪৪ |
প্রতিমন্ত্রী |
বিদেশ সফর |
৩.৭৭ |
৪.৭৬ |
৪.৯৯ |
ঘরোয়া সফর |
৭.৪৪ |
৭.৩০ |
৬.৪৯ |
মোট |
৮১.৫৪ |
৫৬.১৬ |
৬৭৮.৫২ |
(শেষ বারের হিসেব এয়ার ইন্ডিয়ার বকেয়া পাওনা-সহ)
খরচ (কোটি টাকায়) |
|
ব্যয়সঙ্কোচ করে রাজকোষ ঘাটতিতেও যে কতটা রাশ টানা যাবে, থাকছে সেই প্রশ্নও। মন্ত্রী-আমলাদের বিদেশ সফর বাবদ যা ব্যয় হয়, পেট্রোপণ্য বা সারে ভর্তুকির তুলনায় তা খুবই কম। গত আর্থিক বছরে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদের বিদেশ ও ঘরোয়া সফর মিলিয়ে মোট খরচ হয়েছিল মাত্র ৬৭৮ কোটি টাকা। অথচ জ্বালানি ও সারে ভর্তুকির পরিমাণ ছিল ৬৫ হাজার কোটি টাকা। বাজেটে সেটাই কমিয়ে ৪০ হাজার কোটি টাকা করার প্রস্তাব রেখেছেন প্রণববাবু। অর্থাৎ ২৫ হাজার কোটি টাকা ভর্তুকি কমানোর লক্ষ্য নেওয়া হয়েছে। সেই ভর্তুকি কমানোর কোনও ব্যবস্থাই করে উঠতে পারেনি সরকার। কত দিন এই ভাবে ভর্তুকি না কমিয়ে ব্যয়সঙ্কোচের কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়া যাবে, তা নিয়েও প্রশ্ন রয়েছে।
গত বছরও অপ্রয়োজনীয় খরচ কমানোর জন্য বিদেশ সফরে কাটছাঁট করা হয়েছিল। পাঁচতারা হোটেলে সম্মেলনের উপরেও নিষেধাজ্ঞা জারি হয়। একই ভাবে ২০০৯ সালে দ্বিতীয় ইউপিএ-সরকার গঠনের পরেই, আর্থিক মন্দার কারণে কেন্দ্রের সব মন্ত্রক ও দফতরকে পরিকল্পনা বহির্ভূত খাতে খরচ ১০% কমাতে বলা হয়েছিল। কেন্দ্রীয় মন্ত্রীদেরও যাতায়াত করতে হয়েছিল বিমানের ‘ইকনমি ক্লাস’-এ। সরকারি দফতরের নানাবিধ খরচ কমানোরও নির্দেশ দেন অর্থমন্ত্রী। মন্ত্রকের কর্তারাই মানছেন ২০০৯ ও ২০১১ সালে ব্যায়সঙ্কোচের সেই সব পদক্ষেপই আবার ফিরে আসতে চলেছে। অর্থ মন্ত্রকের বক্তব্য, প্রথম দফায় এ ভাবেই প্রাতিষ্ঠানিক খরচ কমানোর চেষ্টা হবে। পরবর্তী ধাপে বিভিন্ন কেন্দ্রীয় প্রকল্পেও খরচ কমানো হবে।
অর্থ মন্ত্রকের এক কর্তার বক্তব্য, “কোথায় ব্যয় কমানো সম্ভব, তা খতিয়ে দেখে বিস্তারিত তালিকা তৈরি করতে হবে। প্রকল্পভিত্তিক খরচ কমানোর বিষয়টি বিভিন্ন মন্ত্রকের সঙ্গে আলোচনা করে তার পর চূড়ান্ত হবে।”
কিন্তু এই ব্যয়সঙ্কোচের কারণ কী শুধুই রাজকোষের ঘাটতি কমানো?
অর্থ মন্ত্রক সূত্রের বক্তব্য, দু’দিন আগে রাজ্যসভায় ব্যয়সঙ্কোচের কথা ঘোষণা করার সময়ই অর্থমন্ত্রী জানিয়েছিলেন, এই পদক্ষেপের মূল উদ্দেশ্য হল সরকারের ‘সক্রিয়তা’ সম্পর্কে বিনিয়োগকারীদের কাছে বার্তা পাঠানো। কারণ, ভারতীয় অর্থনীতি সম্পর্কে মার্কিন মূল্যায়ন সংস্থার নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গির অন্যতম কারণ ছিল সরকারি নিষ্ক্রিয়তা।
এই মূল্যায়ন যে বিনিয়োগকারীদের মনোভাবে প্রভাব ফেলবে, আজ তা আরও এক বার স্বীকার করে নিয়েছেন প্রণববাবু। লোকসভায় এক প্রশ্নের উত্তরে তিনি জানান, “স্ট্যান্ডার্ড অ্যান্ড পুওর্স তাদের রিপোর্টে রাজকোষ ঘাটতি, কারেন্ট অ্যাকাউন্টে ঘাটতি, আর্থিক বৃদ্ধির হার কমে যাওয়া ও ঋণের বোঝা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। এই বিষয়গুলি সরকার গুরুত্ব দিয়ে দেখছে। তবে এসঅ্যান্ডপি মূল্যায়ন করেছে গোটা বিশ্বের সমস্ত দেশের আর্থিক সঙ্কটের নিরিখে। সেই তুলনায় ভারতের অর্থনীতিকে সফল হিসেবেই দেখা উচিত।” প্রণববাবুর দাবি, ব্যয় কমানোর পাশাপাশি বিনিয়োগের পরিবেশ উন্নত করতে, পরিকাঠামো ও শিল্পের উন্নয়নের জন্য এবং মানবসম্পদের গুণগত মান বৃদ্ধির জন্যও পদক্ষেপ করা হচ্ছে। |