বিনোদন বিতর্কের অধ্যায় পেরিয়ে বাংলা ছবিতে এলা
স্বাধীনতার পাঁচ, স্বাধীনতার পঞ্চাশ, রবি ঠাকুরের দেড়শো।
ইতিহাসের তিনটি মুহূর্তে পর্দায় একই উপন্যাসের তিনটি চিত্ররূপ। রবীন্দ্রনাথের ‘চার অধ্যায়’। গ্রন্থাকারে প্রকাশ ১৯৩৪ সালে। বাংলায় বিপ্লবী আন্দোলনের পটভূমিতে লেখা তখন থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত কমবেশি বিতর্ক পিছু ছাড়েনি ‘চার অধ্যায়’-এর। প্রেক্ষাপট স্বাধীনতা সংগ্রামই হোক, অথবা বামপন্থী বা অতি-বামপন্থী আন্দোলন সরকার পক্ষ এবং বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠী, উভয়ের কাছেই ‘চার অধ্যায়’ মতাদর্শগত ভাবেই তাৎপর্যপূর্ণ থেকে গিয়েছে।
১৯৫২ সালের পয়লা জানুয়ারি মুক্তি পায় ‘চার অধ্যায়’ অবলম্বনে প্রথম হিন্দি ছবি ‘জলজলা’। ১৯৯৭ সালে ‘চার অধ্যায়’ নামে একটি দ্বিভাষিক ছবি করেন কুমার সাহনি। বাংলা সিনেমায় ‘চার অধ্যায়’কে পেতে অপেক্ষা করতে হল রবীন্দ্রনাথের সার্ধশতবর্ষ পর্যন্ত। বাপ্পাদিত্য বন্দ্যোপাধ্যায়ের পরিচালনায় ‘এলার চার অধ্যায়’ মুক্তি পেল গত সপ্তাহে।
বাঙালি দর্শকের কাছে অবশ্য দীর্ঘ দিন ‘চার অধ্যায়’ স্মরণীয় হয়ে ছিল তার মঞ্চ-রূপায়ণে। এই উপন্যাসের নাট্যরূপই ছিল ‘বহুরূপী’র প্রথম রবীন্দ্র-প্রযোজনা। এবং সব ঠিকঠাক চললে এ বছর কলকাতার মঞ্চে আবার ফিরে আসবে ‘চার অধ্যায়’। নাট্যরূপ দেওয়ার কাজ শেষ করে ফেলেছেন ব্রাত্য বসু। নাটকটি পরিচালনা করার কথা সুমন মুখোপাধ্যায়ের।
চার অধ্যায় অবলম্বনে নির্মিত তিনটি ছবির পোস্টার।
১৯৫১ সালে শম্ভু মিত্র যখন ‘চার অধ্যায়’কে মঞ্চে আনেন, বামপন্থী মহল তা ভাল চোখে দেখেনি। সত্তরের দশকে ‘চার অধ্যায়’ নব পর্যায়ে মঞ্চে ফিরল। তখন বামপন্থী শিবিরের বিভাজনের সঙ্গে ‘চার অধ্যায়ে’র প্রতি দৃষ্টিভঙ্গিও বিভাজিত হয়ে গিয়েছে। বর্তমানে ‘শ্রীশম্ভু মিত্র’ নাটকের সুবাদে সেই বিতর্কও মঞ্চে উঠে এসেছে। আজকের দর্শকও যে সহজেই ‘চার অধ্যায়ে’র সঙ্গে বর্তমান সময়কে মিলিয়ে দেখতে পারেন, সে কথা মনে করিয়ে দিলেন পাওলি দাম, এলা-র ভূমিকায় নবীনতম অভিনেত্রী। “এই যে দলের তৈরি করা দেশের কথা, দলীয় কর্মীদের ব্যক্তিগত জীবনে হস্তক্ষেপ, দলীয় স্বৈরতন্ত্রের আদল বদলায়নি!”
অভিনয়ের প্রস্তুতি-পর্বে পাওলি ‘চার অধ্যায়ে’র অডিও সিডি শুনেছেন। দেখেছেন কুমার সাহনির ছবিটাও। কুমার নিজে ছবিটি করার আগে শম্ভু মিত্রের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। শুনেছিলেন, ছবিটি করার কথা ভেবেছিলেন সত্যজিৎ রায়ও। “বিতর্কের জন্য তৈরি থাকুন!” ছবির কথা শুনে অশোক মিত্র তৎক্ষণাৎ বলেছিলেন কুমার সাহনিকে। বিতর্ক কম হয়ওনি। অনুমোদন সংক্রান্ত আপত্তি তুলে প্রথমে মামলা ঠুকেছিল বিশ্বভারতী। কাঁচি চালাতে চেয়েছিল সেন্সর বোর্ড। শেষ পর্যন্ত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী ইন্দ্রকুমার গুজরালের হস্তক্ষেপে সেন্সরের কাঁচি ঠেকানো গিয়েছিল। কিন্তু কুমার সখেদে জানালেন, রবীন্দ্রনাথের ১৫০ বছর উপলক্ষে এনএফডিসি ৬টি কাহিনিচিত্রের যে ডিভিডি প্যাকেজ বের করেছে, তাতে ক্লাইম্যাক্স দৃশ্যটি বাদই দেওয়া হয়েছে।
“চৈত মাহিনে কি উস দিন মে ম্যায়নে তুমহারি আঁখোমে মেরা বরবাদি দেখা!” ১৯৫২ সালে গীতা বালি-র ‘এলা’  বলেছিল দেব আনন্দের ‘অতীন’কে। ‘চার অধ্যায়’ অবলম্বনে নির্মিত প্রথম ছবি ‘জলজলা’ পরিচালনা করেন জার্মান চিত্রপরিচালক পল জিলস, যিনি তথ্যচিত্রনির্মাতা হিসেবেই বেশি পরিচিত। ‘চার অধ্যায়ে’র প্রতি তাঁর আকর্ষণের কারণ? যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্রবিদ্যার শিক্ষক মৈনাক বিশ্বাস বললেন, “নিশ্চিত করে বলা মুশকিল।” তবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জার্মান কলাকুশলীদের সন্দেহের চোখে দেখা হত। পল জিলস নিজে বন্দি হয়েছিলেন মিত্রসেনার হাতে। বম্বে টকিজ-এর সঙ্গে কাজ করতে আসা জার্মান দলটির অনেককে ফেরত পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছিল। “এই অভিজ্ঞতাগুলো হয়তো ওঁকে উদ্বুদ্ধ করে থাকবে।”
উপন্যাসটি লেখার পিছনে ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার ভূমিকার কথা স্বয়ং রবীন্দ্রনাথও লিখে গিয়েছেন। ব্রহ্মবান্ধব উপাধ্যায়কে নিয়ে তাঁর সেই লেখা প্রবল বিতর্ক তৈরি করে। রবীন্দ্রনাথ তার জবাবি লেখাও লেখেন ‘প্রবাসী’ পত্রিকায়। সেখানে তিনি চার অধ্যায়কে মূলত প্রেমের গল্প বলে উল্লেখ করেও বলেন, ‘‘এক জন মহিলা আমাকে চিঠিতে জানিয়েছেন যে তাঁর মতে ইন্দ্রনাথের চরিত্রে উপাধ্যায়ের জীবনের বহিরংশ প্রকাশ পেয়েছে আর অতীন্দ্রের চরিত্রে ব্যক্ত হয়েছে তাঁর অন্তরতর প্রকৃতি। এ কথাটি প্রণিধানযোগ্য সন্দেহ নেই।”
মৈনাক এবং কুমার সাহনি দু’জনেই একটা বিষয়ে একমত। স্বাধীনতা, দেশ, দায়বদ্ধতা, মতাদর্শ নিয়ে যে সব প্রশ্ন রবীন্দ্রনাথ তুলেছেন এই উপন্যাসে, তার গুরুত্ব বেড়েই চলেছে। সাহনির কথায়, “স্বাধীনতার আগে ও পরে সরকারের তরফে ‘চার অধ্যায়’কে নানা ভাবে বিক্ষুব্ধ গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করা হয়েছে, এটা দুর্ভাগ্যের।” অন্য দিকে মৈনাক বলছেন, “চার অধ্যায়কে যে ভাবে এক কথায় আন্দোলন-বিরোধী বলে দেগে দেওয়া হয়েছে, সেটা সরলীকরণ ছাড়া কিছু নয়।” মন্ত্রিজীবনের এক বছর কাটিয়ে বিতর্কিত সেই ‘চার অধ্যায়ে’র নাট্যরূপেই প্রথম হাত দিয়েছেন ব্রাত্য। ‘এলার চার অধ্যায়’ ছবিতে এলার ভূমিকায় অভিনয় করে খুশি পাওলি-ও।
সত্তরের প্রেক্ষাপটে লেখা ‘কালবেলা’ উপন্যাস থেকে তৈরি ছবিতে ‘মাধবীলতা’ হয়েছিলেন। এ বার এলা। রাজনীতির ঝড়ে বিধ্বস্ত ভালবাসার দু’টি নারীমুখ। “মাধবী তা-ও অনিমেষকে পেয়েছিল, অর্ককে পেয়েছিল। এলা তো সেটাও পায়নি।” মাধবীলতার সঙ্গে দেখা হলে তবে কী বলবে এলা? এক মুহূর্ত সময় নেন পাওলি।
বলেন, “ভাল আছ তো? নিজের লড়াইটা ছেড়ো না!”



First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.