শহরে ভূগর্ভস্থ জলস্তর নেমে যতই আর্সেনিক-দূষণ ছড়ানোর আশঙ্কা তৈরি হোক না কেন, পূর্ব ও দক্ষিণ কলকাতার বড় একটা অংশে গভীর নলকূপের জল সরবরাহ করা ছাড়া গতি নেই পুরসভার। কারণ, কলকাতায় পানীয় জলের যা চাহিদা, তা গার্ডেনরিচ আর পলতার জল দিয়ে সামাল দেওয়া সম্ভব নয়।
পরিকল্পনা ছিল, গার্ডেনরিচ প্রকল্পের জল পুরসভার সংযোজিত সমস্ত এলাকায় সরবরাহ করা হবে। কিন্তু কার্যত দেখা যাচ্ছে, যাদবপুর, গড়িয়া, সন্তোষপুর, কসবার বিস্তীর্ণ অংশে ওই জল এখনও পৌঁছয়নি। ওই সব এলাকায়, বিশেষত বাইপাসের দু’ধারে যে সব বহুতল রয়েছে, তারা মূলত নিজেদের ব্যবস্থায় গভীর নলকূপের সাহায্যে ভূগর্ভের জল তোলে। পুরসভার সরবরাহ করা যে জল তারা নেয়, তা-ও ওঠে গভীর নলকূপের মাধ্যমে। অর্থাৎ, ওই এলাকায় পুরসভার জলের পুরোটাই ওঠে ভূগর্ভ থেকে। তার পরিমাণ দিনে ৪ কোটি ৩০ লক্ষ গ্যালন।
ভূ-বিজ্ঞানী ও পরিবেশ-বিজ্ঞানীরা কিন্তু কলকাতা পুরসভার ওই অংশটিকেই সব চেয়ে আর্সেনিক-অধ্যুষিত বলে চিহ্নিত করেছেন। তাঁরা বলছেন, দিনে ওই পরিমাণ জল তোলা হলে তা বিপর্যয় ডেকে আনতে বাধ্য। পুর-এলাকায় কোথায় জলস্তর কত, তা কবে শেষ বারের মতো পরিমাপ করা হয়েছিল, কলকাতা পুরসভাই তা জানে না। তারা জানে, ওই সব এলাকায় আর্সেনিক-দূষণের আশঙ্কা প্রবল। তবু গভীর নলকূপ তুলে দেওয়ার কোনও পরিকল্পনাই পুরসভা নিতে পারছে না।
পুরসভারই একটি সূত্রে বুধবার বলা হয়, পুরসভায় নথিভুক্ত বৈধ গভীর নলকূপগুলি যা জল তোলে, শুধু সেই হিসেবই তাদের কাছে রয়েছে। ওই সূত্রটির মন্তব্য, বহুতল আবাসনগুলি বেআইনি ভাবে কতগুলি গভীর নলকূপ বসিয়ে প্রতিদিন মাটি থেকে কত জল তুলছে, তার হিসেব নেই। ভূ-বিজ্ঞানীরা বলছেন, গত কয়েক বছর কলকাতায় বৃষ্টিপাতের পরিমাণ কমেছে। তাই শহরের জলস্তর আরও নেমে যাওয়াটাই স্বাভাবিক। এই অবস্থায় গভীর নলকূপের মাধ্যমে জল তোলা বন্ধ করা না হলে শুধু আর্সেনিক-দূষণই যে বাড়বে তা নয়, ওই সব এলাকায় অদূর ভবিষ্যতে জল তুলতে মাটির বহু নীচে বসাতে হবে পাইপ। পাশাপাশি, মাটির উপরের স্তরের ভারসাম্যও নষ্ট হয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় রয়েছেন ভূ-বিজ্ঞানীরা।
কলকাতা শহরে গভীর নলকূপ বসাতে গেলে রাজ্য জল অনুসন্ধান দফতরের অনুমোদন নিতে হয়। কোথাও কোনও গভীর নলকূপ বন্ধ করার দায়িত্বও ওই দফতরের। কী বলছে তারা? বিজ্ঞানীরা কলকাতার জলস্তর নিয়ে যতই সতর্ক করুন না কেন, ওই দফতর কিন্তু মনে করে, কলকাতায় যথেচ্ছ গভীর নলকূপ ব্যবহারে কোনও ক্ষতির আশঙ্কা নেই। ওই দফতরের অধিকর্তা সুরজিৎ দাস বলেন, “এখনও কলকাতা শহরের ভূগর্ভস্থ জলের তল স্বাভাবিক স্তরে রয়েছে। ফলে গভীর নলকূপের সাহায্যে জল তুললেও ক্ষতির সম্ভাবনা নেই। তবে, আরও বেশ কিছু দিন বৃষ্টি না হলে সমস্যা হতে পারে।” পুরসভার গভীর নলকূপ দফতরের দায়িত্বপ্রাপ্ত মেয়র পারিষদ তারক সিংহ বুধবার বলেন, “কলকাতায় এখন পুরসভার নিজস্ব ৪৩২টি গভীর নলকূপ চালু রয়েছে। সেগুলির মাধ্যমে দৈনিক ৪ কোটি ৩০ লক্ষ গ্যালন জল তোলা ও সরবরাহ হয়।” পুরসভার নথি অনুযায়ী, শহরের বহুতলগুলিতে বৈধ ভাবে রয়েছে মাত্র ৪১৭টি গভীর নলকূপ। বেআইনি ভাবে চলছে আরও ৯৪৫২টি গভীর নলকূপ। এর মধ্যে ৩০০টির বিরুদ্ধে আমরা পুর-আদালতে মামলা রুজু করেছি।” ওই ৯৪৫২টি বেআইনি নলকূপ থেকে দৈনিক কত জল তোলা হয়, তার কোনও হিসেব তাঁর কাছে নেই বলেও জানান তারকবাবু।
রাজ্য জল অনুসন্ধান দফতর সূত্রে বলা হয়েছে, প্রতিটি পুরসভা স্তরে ভূগর্ভস্থ জল উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ রয়েছেন। তাতে সরকারি বিভিন্ন সংস্থার জল-বিশেষজ্ঞেরা আছেন। কিন্তু নতুন গভীর নলকূপ বসানোর আবেদনগুলি বিবেচনার জন্য সংশ্লিষ্ট জায়গায় গিয়ে সব দিক খতিয়ে দেখতে পারে, এমন পরিকাঠামো কর্তৃপক্ষের নেই। তাই আবেদনকারীদের ৯০ শতাংশেরও বেশি নলকূপ বসাতে অনুমতি পেয়ে যান। |