ওষুধ সংস্থার লাইসেন্স নবীকরণ হয়নি, অথচ তারা সরকারি দরপত্রে অংশ নিচ্ছে এবং হাসপাতালে ওষুধ সরবরাহের বরাত পেয়ে যাচ্ছে! একই ভাবে লাইসেন্স দীর্ঘদিন নবীকরণ না-হওয়া সত্ত্বেও অক্সিজেন সংস্থা বহাল তবিয়তে বিভিন্ন সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে অক্সিজেন সরবরাহ করে যাচ্ছে। কিন্তু কী ভাবে? লাইসেন্স নবীকরণ না হওয়ার অর্থই তো ওষুধ সরবরাহ করার ক্ষমতা হারানো।
রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোলের যুক্তি, তাদের পরিকাঠামোর অভাব। ড্রাগ ইনস্পেক্টরের সংখ্যা তলানিতে ঠেকেছে। প্রত্যেক বার প্রতিটি ওষুধ সংস্থা পরিদর্শন করে লাইসেন্স নবীকরণ করা অসম্ভব। তাই কোনও সংস্থা ঠিক সময়ে ফি জমা দিয়ে নবীকরণের আবেদন করলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে, তাদের উৎপাদন পদ্ধতিতে কোনও গোলমাল নেই, উৎপাদিত দ্রব্যের মানও যথাযথ। তাদের ওষুধ সরবরাহের মৌখিক অনুমতিও দেওয়া হচ্ছে।
তা হলে মান নিয়ন্ত্রণের কী হবে? মানুষ হাসপাতাল থেকে কোন মানের ওষুধ পাচ্ছেন? এ ভাবে কেন মানুষের জীবনের সঙ্গে সমঝোতা করা হবে? সেই প্রশ্ন না-তুলে স্বাস্থ্য দফতরও ড্রাগ কন্ট্রোলের এই যুক্তি মেনে নিয়েছে!
নিট ফল কলকাতা-সহ গোটা রাজ্যে সরকারি মেডিক্যাল কলেজ ও হাসপাতালে বছরের পর বছর যে সব সংস্থা ওষুধ বা অক্সিজেন সরবরাহের বরাত পাচ্ছে, তাদের সিংহভাগেরই নবীকৃত লাইসেন্স নেই। তাদের কারখানায় উৎপাদনের উপযুক্ত মান থাকছে কি না, ড্রাগ কন্ট্রোলের ইনস্পেক্টরেরা দেখতেও যাচ্ছেন না। সংস্থাগুলির কাজকর্ম সম্পর্কে তথ্য থাকছে না ড্রাগ কন্ট্রোলে। কেউ জানতে পারছেন না, ওই ওষুধে রোগ সারবে কি না।
সম্প্রতি রাজ্য স্বাস্থ্য দফতর বিভিন্ন মেডিক্যাল কলেজে তরল অক্সিজেন সরবরাহের জন্য দরপত্র ডাকে। তাতে অংশগ্রহণকারী এক অক্সিজেন সংস্থার কাগজপত্র খতিয়ে দেখতে গিয়ে হেল্থ সার্ভিস কর্পোরেশনের কর্তাদের নজরে পড়ে, ওই নামী সংস্থার কলকাতার কারখানার লাইসেন্স ১৯৯৫ সাল থেকে নবীকরণই করা হয়নি। অথচ, সেই সংস্থা এ রাজ্যের প্রত্যেকটি মেডিক্যাল কলেজে গত কয়েক বছর ধরে পাইপলাইন ও সিলিন্ডারে অক্সিজেন সরবরাহ করে আসছে। এর পরেই বিষয়টি নিয়ে নাড়াচাড়া শুরু হয়। দেখা যায়, শুধু ওই সংস্থাই নয়, সেন্ট্রাল মেডিক্যাল স্টোর যে ক’টি সংস্থাকে কলকাতা ও বাকি জেলায় সরকারি হাসপাতালে ওষুধ সরবরাহের বরাত দিয়েছে, তার অধিকাংশেরই লাইসেন্স নবীকরণ হয়নি দীর্ঘদিন।
কিছু দিন আগেই কেন্দ্রীয় ড্রাগ কন্ট্রোলের কাজকর্ম নিয়ে পার্লামেন্টে সংসদীয় কমিটির পেশ করা রিপোর্টে বিতর্ক শুরু হয়েছে। ওই রিপোর্টে বলা হয়েছিল, তৃতীয় দফার ড্রাগ ট্রায়াল ছাড়াই বেশ কিছু বিদেশি ওষুধকে ভারতের বাজারে চালুর অনুমতি দিয়েছিল ড্রাগ কন্ট্রোল। সেখানে রাজ্য স্তরের ড্রাগ কন্ট্রোলগুলির পরিকাঠামোর অভাব এবং অফিসারের অভাবের কথাও বলা হয়েছিল। সেই প্রেক্ষিতেই এ রাজ্যে বিভিন্ন ওষুধ সংস্থার লাইসেন্স নবীকরণ না-করেই তাদের ওষুধ সরবরাহের মৌখিক অনুমতি দেওয়াকে আলাদা গুরুত্ব দিচ্ছে স্বাস্থ্য দফতর। দফতরের মুখপাত্র অসিত বিশ্বাসের কথায়, “আমরা বিষয়টি জেনেছি এবং ঘটনাপ্রবাহের দিকে নজর রাখছি। আলোচনা করে সমাধানসূত্র বার করা হবে।”
আর রাজ্য ড্রাগ কন্ট্রোল কর্তৃপক্ষের যুক্তি, “কলকাতায় ড্রাগ ইনস্পেক্টর সাকুল্যে ২২ জন। অথচ, ওষুধের দোকান ও কারখানা কয়েক হাজার। লোক না-বাড়ালে কী ভাবে নজরদারি চলবে? গোটা রাজ্যের জন্য রয়েছেন মোটে ৬৯ জন ইনস্পেক্টর। তাঁদের পক্ষে প্রত্যেক বার প্রতিটি সংস্থার লাইসেন্স নবীকরণের আগে পরিদর্শন করা অসম্ভব।” যে অক্সিজেন সংস্থার লাইসেন্সকে কেন্দ্র করে গোটা ব্যাপারটি সামনে এসেছে, তার বিষয়ে ওই কর্তা বলেন, “ওই সংস্থা প্রতিবারই সময়মতো টাকা দিয়ে লাইসেন্স নবীকরণের আবেদন করে। আমরাই পরিদর্শনে যেতে পারিনি। তাই নবীকরণ ছাড়াই ওদের কাজ চালিয়ে যেতে বলেছি। বেশির ভাগ সংস্থা আবেদন করার পরে আলাদা করে লাইসেন্স নবীকরণের জন্য তাড়াও দেয় না। কারণ, আমরা পরিদর্শনে গিয়ে ফাঁক ধরে ফেললে ওদেরই অসুবিধা। তাই এই ভাবেই চলছে।” |