কী করতেন সচিন তেন্ডুলকর! যদি মাইক গ্যাটিংয়ের বদলে তিনি খেলতেন শতাব্দীসেরা ডেলিভারিটা?
বীরেন্দ্র সহবাগ: ইজি চার মারত ফাইন লেগ দিয়ে। ওয়ার্নের ভাগ্য ভাল বিপক্ষে সচিন ছিল না।
হরভজন সিংহ: এটা আবার কোনও প্রশ্ন? প্যাডল সুইপ করত। সোজা চার।
সুনীল নারিনের যে বলটা অফের বাইরে থেকে টার্ন করে অতর্কিতে বাউন্স করল তার বিরুদ্ধে তেন্ডুলকর কী করতেন তা নিয়ে অবশ্য কোনও গবেষণা, তর্ক বা সচিনের সহ-খেলোয়াড়দের ইন্টারভিউয়ের সুযোগ নেই। ওয়াংখেড়েতে ঘরের মাঠে ডেলিভারিটা সামলাতে না পেরে সচিন পরিষ্কার বোল্ড হয়ে গেলেন। পূর্ণিমার রাতে যেন আচমকা নেমে এল অমাবস্যা। অন্তত মাঠের মেজাজ দেখে তাই মনে হল।
অ্যাসেজ টেস্টে দিনের শেষ বলে গ্যাটিংকে আউট করা ওয়ার্ন-ডেলিভারিটা যদি শতাব্দীসেরা হয়, বুধবারের নারিনেরটা নিশ্চয়ই সর্বকালের আইপিএলসেরা। তাৎপর্যপূর্ণও! |
ওই একটা ডেলিভারি ম্যাচের মোড়ই ঘুরিয়ে দিল না, স্টিং অপারেশন ক্লিষ্ট ক্রিকেটকে চব্বিশ ঘণ্টার মধ্যে ফের ফিরিয়ে দিল স্কিলের স্বর্ণ সিংহাসনে। মুম্বই যখন মাত্র ১৪১ তাড়া করে এক উইকেটে ৬০ এবং ম্যাচ সম্পূর্ণ ধরে ফেলেছে সেই সময় তেন্ডুলকর আউট হয়ে গেলেন। আর গম্ভীরের কেকেআরকে তখনই যেন তুলে দিয়ে গেলেন তার উপর্যুপরি আইপিএল সেমিফাইনালে। হরভজনের মুম্বই ইন্ডিয়ান্সের জয় অবশ্যম্ভাবী দেখাচ্ছিল। অথচ তারাই কিনা পুরো কুড়ি ওভার খেলতে না পেরে ৩২ রানে হেরে গেল। গত পরশু রজত ভাটিয়ার শেষ বলে ছক্কা হয়ে যাওয়া নাইট সমর্থকের অন্তরে যত মর্মান্তিক আর আগুনে পোড়ার মতো দেখা দিয়েছিল, আজকেরটা যেন তেমনই শ্যাম্পেনের ফেনার মতো উড়ে গেল চার দিকে। বিগত পাঁচ আইপিএলে কেকেআরের প্রত্যাবর্তনধর্মী সেরা ম্যাচ বোধহয় এটাই।
ওয়াংখেড়েতে অমাবস্যা নেমে আসা রাতের ফলে যা দাঁড়াল: আগামী শনিবার পুণেতে দাদার ওয়ারিয়র্সকে যদি হারাতে পারে কেকেআর, তা হলে প্রথম দুই দলের মধ্যে চলে যাবে। আপাতত তাদের ১৫ ম্যাচে ১৯ পয়েন্ট। পরিতৃপ্ত গৌতম গম্ভীর বলছিলেন, “গত বার পুরো টুর্নামেন্ট ভাল খেলে একটা বিবর্ণ সেমিফাইনালের জন্য আমাদের ছিটকে যেতে হয়েছিল। এ বার তাই পুণে ম্যাচটা জিততে চাই। যাতে এক-দুইয়ের মধ্যে থাকি। আর প্রয়োজনে দুটো সেমিফাইনাল খেলার সুযোগ পাই।”
গম্ভীরকে জিজ্ঞেস করা হল, সুনীল নারিনকে কেউ খেলতে পারছে না। আপনি নেটে কী করে খেলেন? গম্ভীর হেসে ফেললেন। বললেন, “আমি তো খেলি নেটে। তাই আমার সমস্যা নয়। যারা ম্যাচে গিয়ে ওকে খেলতে পারছে না তাদের জিজ্ঞেস করুন।” মুম্বই কোচ রবিন সিংহ অবধি বলে গেলেন, “ও হচ্ছে কলকাতার মালিঙ্গা।” আসলে মালিঙ্গাকেও পেছনে ফেলে এ দিন চলতি আইপিএলের সেরা বোলার হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হলেন নারিন। বুধবারও ১৫ রানে ৪ উইকেট এমন টিমের বিরুদ্ধে যারা ঘরের মাঠে টস জিতে ফিল্ড নিয়েছিল। আর ভুল কম্বিনেশন খেলাল পেসার বাড়িয়ে। মানে এটা তো শুধু হরভজনের ভুল হতে পারে না। স্ট্র্যাটেজিগত সহায়তায় তা হলে তেন্ডুলকরেরও গণ্ডগোল হয়েছিল। কতকটা অবিশ্বাস্য যে, এই ব্যাটিং নিয়ে ওয়াংখেড়েতে ৮ ম্যাচের মধ্যে ৫ বার হারল এমআই। এ দিন এমন একটা টিমের বিরুদ্ধে যারা ফিল্ডিংয়ে অনবরত বল গলিয়েছে, ক্যাচ ফেলেছে। আম্পায়ারের দুটো ভুল সিদ্ধান্তের শিকার হয়েছে। একটায় ম্যাকালামকে আউট দেওয়া হয়। অন্যটায় শূন্য রানে থাকা তেন্ডুলকরকে নটআউট ঘোষণা করা হয়।
একটা জুজুও যেন বুধবার মাঝরাতে ভেঙে গেল। যে কলকাতা আর যা-ই পারুক, মুম্বইতে এসে মুম্বইকে হারাতে পারে না। ‘ব্র্যান্ড বাংলা’ শুটিংয়ের জন্য এ দিন বিকেল চারটের সময় মেহবুব স্টুডিওতে পৌঁছনো শাহরুখ খানকে ছেড়ে দিতে হবে তাড়াতাড়ি। আটটা থেকে তো ওয়াংখেড়েতে ম্যাচ। আর অফিস টাইমের বান্দ্রা থেকে মেরিন ড্রাইভ পাক্কা দেড় ঘণ্টার রাস্তা। অথচ পরিচালক অনিরুদ্ধ রায়চৌধুরি অবাক হয়ে দেখছেন, কেকেআর মালিকের কোনও তাড়া নেই। রিল্যাক্সড্ হয়ে কাজ করছেন। শটের মধ্যে গ্যাঁজাচ্ছেন। শুটিং শেষ করে যখন তিনি গাড়িতে উঠব উঠব, ব্রেন্ডন ম্যাকালাম তখুনি জঘন্য এলবিডব্লিউ সিদ্ধান্তের শিকার হয়ে প্যাভিলিয়নের দিকে। এসআরকে মন্নতে ঢোকার আগে জাক কালিসও ব্যাট-প্যাডের ফাঁক দিয়ে প্রথম বলে বোল্ড। মনোজ তিওয়ারি নামছেন হ্যাটট্রিক রুখতে।
আর পি সিংহ নামক কার্টুন পেস বোলার হিসেবে হালফিল গণ্য হতে থাকা প্রতিযোগী যে এমন ওয়াংখেড়ে-ধমাকা তৈরি করতে পারেন সেটা বিস্ময়ের অবশ্যই। শাহরুখের ওয়াংখেড়েমুখী না হওয়াটা? আদৌ নয়!
আইপিএলের সব ক’টা ম্যাচ যিনি অনন্ত ব্যস্ততার মধ্যেও নিয়ম করে হিল্লি-দিল্লি হাজির থেকেছেন, তিনি নিজের শহরে স্টেডিয়ামমুখী হলেন না কেন? উত্তর খুব সহজ মুম্বইকরদের বিদ্রুপের লক্ষ্যবস্তু হওয়া থেকে রেহাই নিতে। এর আগে যখনই কেকেআর বনাম মুম্বই ইন্ডিয়ান্স দেখতে তিনি ওয়াংখেড়ে এসেছেন, জনতা তুমুল ব্যারাকিং করেছে। ওহে, তুমি মুম্বই শহর থেকে নাম কিনে কিনা আমাদেরই হারাতে চাইছ!
এমনিতেও মুম্বইয়ের মাটির লড়াই শাহরুখের কাছে খুব স্পর্শকাতর বিষয়। আইপিএলের প্রথম বছরটা তাঁর অভ্যেস ছিল টিমকে খেলার দিন সকালে এসএমএস করা। মুম্বইয়ের মাঠে খেলার দিন সেই টেক্সট মেসেজে ছিল: কোনও দিন তোমাদের কাছে কিছু চাইনি। আজ চাইছি। এই শহরটার লোকে আমায় কিং বলে ডাকে। সেই সম্বোধনটার মর্যাদা দাও ম্যাচ জিতে। অদৃষ্টের পরিহাসে সেই ম্যাচটাই মাত্র ৬৭ রানে অলআউট হয়ে ৯ উইকেটে উড়ে যায় সৌরভের টিম। কেকেআরের অভিশপ্ত মুম্বই অভিযানের সেই শুরু। আজকের আগে পর্যন্ত এখানে তিন বার খেলে কেকেআর কখনও জেতেনি। সন্ত্রস্ত শাহরুখও তাই ওয়াংখেড়ে মাঠের সংস্পর্শ ত্যাগ করেছেন।
তাঁর অধিনায়ক অবশ্য সহজে হার মানার পাত্র নন। এ দিন বিকেল পৌঁনে ছ’টা নাগাদ নাইটরা যখন হোটেলের নীচে টিম মিটিংয়ে যাচ্ছে, গৌতম গম্ভীরকে থামালেন তাঁর পরিচিত এক বন্ধু। বললেন, আবার সেই ওয়াংখেড়ে। আবার মালিঙ্গা। বেস্ট উইশেস ২ এপ্রিলের সেই রাতটাই ১৬ মে-তে ফেরত আসবে।
গম্ভীর শুরুও করেছিলেন সেই ভাবে। যেন বিশ্বকাপ ফাইনালে দু’উইকেট দ্রুত চলে যাওয়ার রাতের মতোই আজও তিনি অকুতোভয়। প্রথম বলটাই গাওস্কর স্পেশ্যাল স্ট্রেট ড্রাইভ। বাউন্ডারি। একাই যেন জিতিয়ে দেবেন টিমকে। প্রথম ৬ ওভারে মাত্র ৩১-২। পুণে ওয়ারিয়র্সের প্রথম ছয় ওভার সদৃশ। তবু স্টেডিয়ামের দক্ষিণ দিক থেকে তীব্র আওয়াজ উঠছে, গম্ভীর...গম্ভীর। বোঝা গেল শাহরুখের ফিল্মি বন্ধুবান্ধবেরা গোটা আইপিএলের মতো আজও কৌতূহলজনক ভাবে বলিউডের শহরে অনুপস্থিত থাকতে পারেন, প্রবাসী বাঙালি প্রচুর এসেছে।
পোলার্ডের একটা বল সামান্য মুভ করল। গম্ভীর লাইন মিস করলেন। ২৩ বলে ২৭। দেখা গেল, মাসটা মে-ই থেকে গেল। এপ্রিলের রেট্রোসপেক্টিভ হল না।
নাইটদের স্ট্র্যাটেজিতে একটা বুদ্ধিদীপ্ত পরিবর্তন অবশ্য লক্ষ্য করা গেল। আজ আর তিওয়ারি-পাঠান তৃতীয় উইকেট থেকে একসঙ্গে নয়। রোজ এই জুড়িই উদ্ধত তারুণ্য দাবি করে এমন সময় পেনশনারদের মতো খেলে খেলে টিমের সলিলসমাধি ঘটাচ্ছিলেন। দু’জনেই ভয়ঙ্কর চাপে। তিওয়ারি বিপক্ষ বোলার এবং ভারতীয় দলে ফিরে আসার সুড়ঙ্গ থেকে নিষ্ক্রমণ দুইয়ের চাপে দিশেহারা। এ দিন মনোজ অপেক্ষাকৃত ভাল খেললেও ৪৩ বলে ৪১। বল পিছু এক রানও নয়। স্ট্রাইক রেট প্রতিযোগিতায় ১০৫। ম্যাচ শেষে অবশ্য কেকেআর অধিনায়ক মনোজের ব্যাটিংয়ের প্রশংসা করলেন। আর ইউসুফের যে এ মাঠেই মাত্র ৩৭ বলে আইপিএলের দ্রুততম সেঞ্চুরি আছে বলে না দিলে কারও বোঝা সম্ভব নয়। ওয়ার্নের হয়ে যে তিন নম্বরে বিপক্ষকে পিষত। আর এ যে গম্ভীরের হয়ে পাঁচে নামে, সে পুরনো লোকটার ছায়ামূর্তি। আজকে এর স্ট্রাইক রেট দাঁড়াল ১০০। লোকে সৌরভ গঙ্গোপাধ্যায় নিয়ে কথা তোলে। ভারতীয় ক্রিকেটের এই দুই তরুণ তারকা বরঞ্চ অসীম ভাগ্যবান। তাঁদের টিম মালিকের নাম বিজয় মাল্য নয়, সুব্রত রায়ও নয়।
বিপদ আন্দাজে নাইট ম্যানেজমেন্ট তাই বড় রানের রাস্তায় তিওয়ারি-পাঠান বাম্পের মধ্যিখানে সাকিবকে গুঁজে দিয়েছিল। কিন্তু তিনিও আইপিএল ব্যাটিং অদ্যাবধি রপ্ত করতে পারছেন না। ভারতীয় ক্রিকেটের মক্কায় হাসফাঁস করতে থাকা সাকিবদের দেখে তখন মনে হচ্ছে, গম্ভীরের প্রিয় দাসি-কে (দেবব্রত দাস) কি তিন নম্বরে পাঠানো যায় না প্রতি ম্যাচে? অন্তত সুইসাইড বম্বার হিসেবে? মরল অথবা মারল। এ দিন সাত নম্বরে আসা দাসি দু’টোর কোনওটারই সুযোগ পাননি। পাঠানের একটা ভুল ‘কল’ তাঁকে রান আউট করালো। আর টিভির সামনে বসে থাকা শাহরুখকে নিশ্চয়ই বলাল, আমার মাঠে না আসার ‘কল’টা যথার্থ ছিল!
চেন্নাইতে আইপিএল ফাইনালের দিন যিনি ৫০ বছরে পা দেওয়ার পার্টিটা দেবেন কিনা ভাবছেন, সেই রবি শাস্ত্রী অবশ্য তখনও কেকেআর মালিকের জন্য আশা দেখছেন। বললেন, “উইকেটটা অদ্ভুত রকম। ১৫০ তোলা সহজ হবে না।” কে জানত, শাস্ত্রীয় ভবিষ্যদ্বাণী এমন অমোঘ ফলে যাবে। ম্যাচের দুই-তৃতীয়াংশ কোণঠাসা গম্ভীর সাংবাদিক সম্মেলনে বিরল হাসিমুখে থাকবেন। হরভজন আসবেন না। আর মুম্বই কোচ এক রকম দাঁত কিড়মিড় করবেন, “উইকেটকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। যারা ১৪১ করতে পারে না তাদের জেতা উচিত নয়।” প্রসঙ্গত, সচিন তেন্ডুলকরের মুম্বই আইপিএল আকাশে ফের মেঘের আড়ালে চলে গেল। দ্রাবিড়ের রাজস্থানকে হারাতে না পারলে টুর্নামেন্ট থেকেই ঘচাং ফু!
|