|
|
|
|
প্রবন্ধ ২... |
‘সর্বজনীন পণ্য’ কারা পাচ্ছেন? |
রাস্তাঘাট, প্রাথমিক শিক্ষা, পানীয় জল পৌঁছয় না ভূমিহীন-প্রধান গ্রামে।
সামাজিক বৈষম্য পোক্ত করে দারিদ্রকে। লিখছেন
শৈবাল কর |
গরিব কে, তা নিয়ে বার বার বিতর্ক উঠছে। গরিব কত, তা নিয়েও দর কষাকষি চলছে অর্থনীতির বিশেষজ্ঞ আর রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে। কিন্তু গরিব কেন, সে প্রশ্নটা ঠিক তেমন করে সামনে আসছে না। যে নিজের শ্রম বা দক্ষতা দিয়ে যথেষ্ট রোজগার করছে না, সে-ও যাতে নিজের জন্য এবং পরিবারের জন্য সুস্থ, সক্ষম জীবন তৈরি করতে পারে, তার জন্য অনেক সহায়তার ব্যবস্থা রয়েছে শস্তায় দু’মুঠো ভাত, মাথার উপর ছাদ, ইস্কুলে পড়াশোনা, অসুখে চিকিৎসা, এগুলো যাতে পৌঁছে যায় দরিদ্রতম মানুষদের কাছে, তার জন্য সরকার খুব কম টাকা খরচ করছে না। সেই সুযোগসুবিধেগুলো গরিবের কাছে পৌঁছলে তাঁদের জীবন অনেক সহনীয় হত, সন্দেহ নেই। উন্নয়নের নানা কর্মসূচিতে বিপুল ব্যয়ের পরেও যে দারিদ্র কমছে না, তা থেকে বোঝা যায় যে, রাস্তাঘাট, বিদ্যুৎ সংযোগ ইত্যাদি ‘পাবলিক গুডস’ বা সর্বজনীন সামগ্রী বণ্টন এবং ব্যবহারে সমস্যা থেকে যাচ্ছে।
এমনকী এই সর্বজনীন সামগ্রী কোথায় কতটা অমিল, সে বিষয়ে যথেষ্ট তথ্যও সরকারের কাছে নেই। যোগাযোগ ব্যবস্থা, পরিশুদ্ধ পানীয় জলের জোগান, বিদ্যুৎসংযোগ আছে না নেই, বাসরাস্তা গ্রাম থেকে কত দূর, গ্রামীণ স্বাস্থ্য কেন্দ্রের হাল, জেলা শহরের হাসপাতালে যেতে কত সময় লাগে, ইত্যাদি তথ্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। মাথাপিছু পানীয় জলের ভাণ্ডার, বিদ্যালয়ের স্তর ও উৎকর্ষ, সরকারি স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিশুদের টিকাকরণ, মায়ের স্বাস্থ্য ইত্যাদি বিষয় পরস্পরের সঙ্গে সম্পৃক্ত এই রকম অনেকগুলো বিষয়ের উপর ভিত্তি করে এক-একটি গ্রামকে পয়েন্ট দেওয়া যায় এবং তাদের মধ্যে শ্রেণিবিন্যাস করা যায়। |
|
পরিষেবা। প্রাথমিক স্বাস্থ্য কেন্দ্র, ঘুটিয়ারি শরিফ। ছবি: পিন্টু মণ্ডল |
গড় পয়েন্টের থেকে যে গ্রামগুলোর প্রাপ্ত পয়েন্ট কম, দেখা যাবে তারা এক ধরনের আর্থ-সামাজিক দূরত্বের শিকার। এবং এই দূরত্ব শুধু ভৌগোলিক নয়, বিভিন্ন সামাজিক গোষ্ঠীর মধ্যেও বিদ্যমান।
কিছু দিন আগে কোচবিহার জেলার বিভিন্ন ব্লকের পঞ্চাশটি গ্রামে একটি আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা করা হয়, যার লক্ষ্যই ছিল সমাজের বিভিন্ন গোষ্ঠীর মধ্যে এই দূরত্ব পরিমাপ করা। সংখ্যাতত্ত্বের সাহায্যে পঞ্চাশটি গ্রাম বেছে নেওয়া হয় এবং প্রত্যেকটিতে তিরিশটি গৃহস্থবাড়ি এই সমীক্ষায় অংশগ্রহণ করে। সব গ্রামগুলিতেই তফসিলি জাতি ও জনজাতির অন্তর্ভুক্ত গোষ্ঠীর মানুষ রয়েছেন, যদিও শতাংশের হিসেবে কোথাও খুব বেশি, কোথাও সামান্য। সাধারণ ভাবে দেখা যাবে, যে গ্রামে ভূমিহীন কৃষক বা খেতমজুরের সংখ্যা প্রচুর, সেখানে পানীয় জলের অভাব প্রকট, গ্রামের অধিকাংশ বাড়ি কাঁচা, জেলা হাসপাতাল অন্তত পঁচিশ কিলোমিটার দূরে, ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের সমস্যা যে-কোনও উন্নয়নের সূচককে নিম্নগামী করে রাখবে। এই গ্রামগুলিতে প্রায় ৮৫ শতাংশ সন্তান প্রসব বাড়িতে হয়ে থাকে অস্বাস্থ্যকর অবস্থায়, অর্ধশিক্ষিত ধাত্রী বা হাতুড়ে ডাক্তারের সহায়তায়।
তবে, সব জায়গায় বা সব গোষ্ঠীর মধ্যে সমস্যার চিত্র এক রকম নয়। যেমন ধরুন, মাথাভাঙ্গা ব্লকের পতাকামারী গ্রামে পানীয় জল, নিকাশি ব্যবস্থা বা পাকা বাড়ির অনুপাত সমীক্ষার অন্তর্ভুক্ত পঞ্চাশটি গ্রামের মধ্যে সবচেয়ে ভাল। মাথাভাঙ্গা-১ নম্বর ব্লকের অন্তর্গত ইন্দরকুঠি ও ছাট খগড়িবাড়ি গ্রামগুলিতে এই দুটির ব্যবস্থা ভয়ানক রকম খারাপ। লক্ষণীয় ব্যাপার, যে গ্রামগুলিতে তফসিলি জাতির উপস্থিতি অনেক বেশি, সেখানে অল্পসংখ্যক সাধারণ বাড়ি অবহেলিত এবং এর বাসিন্দারা আর্থ-সামাজিক ভাবে কোণঠাসা। এর বিপরীতটাই এত দিন ভারতের মানুষ জেনে এসেছেন নিয়ম বলে। আশ্চর্য ব্যাপার এই যে, পতাকামারী গ্রামে গার্হস্থ্য সুযোগসুবিধা বেশ ভাল হলেও শিক্ষার সুযোগের নিরিখে তা ভীষণ রকম পিছিয়ে। এখানে মিড-ডে-মিলের জোগান, স্কুলের পোশাক, সরকারি সাহায্যে বই-খাতার জোগান, শিক্ষকের নিয়মিত উপস্থিতি, শিক্ষার গুণগত মান সব মিলিয়ে গ্রামটির স্থান একেবারে নীচের দিকে। অন্য দিকে, বড়-বাংলা গ্রামে শিক্ষার পরিবেশ এই সমীক্ষা অনুযায়ী সবচেয়ে ভাল। শিশুদের শ্বাসকষ্টজনিত সমস্যা ও ডায়েরিয়ার প্রকোপ সিতাই ব্লকের সতীমারী গ্রামে ও মেখলিগঞ্জ ব্লকের বড়-নিজতরফ গ্রামে সর্বাধিক। সরকারের ঢালাও ব্যবস্থার মধ্যে এই গ্রামগুলি এই বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করছে কি না তার কোনও নিশ্চয়তা নেই। অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায়, পঞ্চায়েতের বিশেষ ঘনিষ্ঠ ৫ থেকে ৭ শতাংশ গ্রামবাসী ব্যতীত প্রায় কেউই জানেন না যে ইন্দিরা আবাস যোজনায় কত টাকা পাওয়া গিয়েছে এবং তা কী ভাবে ব্যবহার করা যায়।
এই গবেষণা থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, পাবলিক গুডস-এর ব্যবহারে স্থানগত এবং গোষ্ঠীগত বৈষম্য দারিদ্র কমানোর কাজে এক প্রধান বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে। দেশের সর্বত্রই দুরবস্থার চিত্র কিন্তু এক রকম নয়। পিছিয়ে পড়া রাজ্যগুলি এবং তাদের মধ্যে পিছিয়ে পড়া জেলাগুলিতে সমস্যার প্রকোপ স্বভাবতই বেশি। বাংলায় পুরুলিয়া কি কোচবিহার, ওড়িশায় গজপতি, ছত্তীসগঢ়ের অনেকগুলি জেলা, ঝাড়খণ্ড, অসম, রাজস্থান আরও পিছিয়ে পড়ছে।
এর মধ্যে বেশ কিছু জেলা কোনও না কোনও বিছিন্নতাবাদী দলের কব্জায়। স্থানীয় মানুষজন বিশ্বাস করেন যে, তাঁদের বঞ্চনার কাহিনি সরকারি দফতরে পৌঁছে দেওয়ার এটাই সহজতম উপায়। তথ্যের উন্নত আদানপ্রদানে যদি বণ্টন ব্যবস্থা যথাযথ হয়, তবে সামাজিক দূরত্ব বিচ্ছিন্নতাবাদের অন্যতম অস্ত্র হয়ে উঠতে পারবে না ভবিষ্যতে।
|
কলকাতায় সেন্টার ফর স্টাডিজ ইন সোশাল সায়েন্সেস-এ অর্থনীতির শিক্ষক |
|
|
|
|
|