প্রবন্ধ ১...
‘বউয়ের গায়ে আর হাত তুলব না, তাকে সম্মান করব’
ই ক্যান জিন্দাবাদ’। ‘আমরাই পারি জিন্দাবাদ’। ‘বদলাও জিন্দাবাদ’, এই স্লোগানগুলিকে আকাশে ছুড়ে দিচ্ছিল প্রায় ৭০/৮০টি মুষ্ঠিবদ্ধ হাত। দক্ষিণ ২৪ পরগনায় মগরাহাট ২ নম্বর ব্লকে জয়েন খাঁ গ্রামে।
এ কোনও রাজনৈতিক পালাবদল নয়। ভারতে যে মহিলাদের এক-তৃতীয়াংশই শারীরিক নির্যাতনের শিকার হন, দেশের ৩৫ শতাংশ মহিলাকেই যে ভাবে শারীরিক ও যৌন নিগ্রহের বলি হতে হয়, প্রতি ৫ জন বিবাহিত মহিলার মধ্যে ২ জনের ওপরই স্বামীরা যে ধরনের অত্যাচার করে, সেই সব মহিলাদের প্রতি দমন, পীড়ন ও নির্যাতন বন্ধ করার ওই অঙ্গীকার। তাদের সেই দমবন্ধ হয়ে আসা দুঃস্বপ্নের জীবনে বদলের মুক্ত বাতাস বইয়ে দেওয়ার অঙ্গীকার।
দুনিয়ায় মেয়েদের প্রতি নিরবচ্ছিন্ন হিংসার ধারাবাহিকতায় কখনও কোনও ছেদ পড়েনি। দক্ষিণ এশিয়ায় এই হিংসা অত্যন্ত বেশি। এখানে শতকরা ৫০ ভাগ মেয়েই তার প্রাত্যহিক জীবনে কোনও না কোনও অত্যাচারের শিকার। এলাকায় মেয়েদের প্রতি নিরন্তর ঘটে চলা সেই সব হিংসা ও বৈষম্যের কারণগুলি তুলে ধরে তাকে নির্মূল করার চেষ্টাতেই শুরু হয়েছিল ‘উই ক্যান’ ক্যাম্পেইন বা ‘আমরাই পারি’ প্রচার অভিযান। অক্সফাম ইন্টারন্যাশনাল-এর উদ্যোগে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারত, বাংলাদেশ, পাকিস্তান, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তান ইত্যাদি ৬টি দেশে ছয় বছর ধরে চলেছে এই অভিযান।
জয়েন খাঁ গ্রামে পারিবারিক হিংসার বিরুদ্ধে নাটক করছে ছেলেমেয়েরা। ছবি: লেখক
জয়েন খাঁ গ্রামে সেই অভিযানেরই একটি খণ্ডচিত্রের মুখোমুখি হলাম সে দিন। উঠোনে এক পাশে ধানের গাদায়, ঘরের দেওয়ালে আটকানো ছিল ‘হিংসামুক্ত জীবন সবারই অধিকার’, ‘এসো পাল্টাই, ঘরে বাইরে সবখানেতেই’ ইত্যাদি সব পোস্টার। চলছিল পারিবারিক হিংসা নিয়ে কয়েকজন কিশোর-কিশোরীর অভিনীত কয়েক মিনিটের ছোট্ট একটি নাটক। নাটক শেষে তাই নিয়ে পরস্পরের মধ্যে কথোপকথন শুনতে শুনতে এবং এই আত্মপ্রত্যয়ী মুখগুলি দেখতে দেখতে মনে হচ্ছিল, তাঁদের দৃঢ় মুষ্ঠিবদ্ধ হাতগুলি সত্যি হয়তো অনেক কিছু বদলে দিতে পারে। কী ভাবে তাঁরা এই পরিবর্তনকারী হয়ে উঠছেন? সে দিন মায়ারানি ও পরিতোষ পুরকায়েত, রশিদ শেখ, নবকুমার সর্দার, অপর্ণা মণ্ডলদের কথায় কথায় তার ছবিটা স্পষ্ট হল। চকপরান কাঁটাখালি গ্রামের বছর সাতান্নর পরিতোষ পুরকায়েত কৃষিমজুর, যাঁর ‘আয়ের তিন ভাগই উড়ে যেত মদের নেশায়। না খেয়ে, আধপেটা খেয়ে কাটত। পাঁচ ছেলেকে পড়াতে পারিনি। মাসে অন্তত ১৫ দিনই স্বামী গায়ে হাত তুলত।’ দুঃখের এই সব স্মৃতি হাতড়েও স্ত্রী মায়ারানির মুখ উজ্জ্বল হয়ে উঠল, যখন তিনি বলতে লাগলেন, কী ভাবে তাঁর সেই স্বামীই এক দিন আত্মীয়পরিজন ও পাড়া প্রতিবেশীদের সাক্ষী রেখে শপথ নিলেন ‘আর কোনও দিন মদ খাব না। বউয়ের গায়ে হাত তুলব না, তাকে সম্মান করব।’ এবং সেই থেকে পরিতোষ ‘এক দিনও আর গায়ে হাত তোলেনি। খারাপ কথাও বলেনি’। নিরন্তর সেই অপমান ও নির্যাতনের গ্লানি থেকে মুক্তি পেয়েছেন মায়ারানি, তাঁর বিয়ের পনেরো বছর পর।
এবং পরিতোষ বছর তিনেক হল শুধু নিজে মদের নেশা ছাড়েননি, তাঁদের আড্ডার বাকি ৪ জনকেও মদ ছাড়িয়েছেন। এবং বেশ গর্বের সঙ্গে বললেন, ‘ছেলেদের নিয়ে গিয়ে মদের ঠেকও তুলে দিয়েছি।’
তাঁর মতোই পরিবর্তনকারী হয়ে উঠেছেন উত্তর মাধবপুরের একদা দুর্দান্ত রশিদ শেখ। ২০০৮-এ ‘আমরাই পারি’-র প্রথম মিটিংয়ে যাওয়ার জন্য জাহানারা বিবি তাঁর স্বামী রশিদ শেখের হাতে প্রচণ্ড মার খেয়েছিলেন। এবং পাড়ার কোনও মেয়েই যাতে সেই সব মিটিংয়ে আর না যেতে পারে, জরি-কর্মী রশিদ তাই নিয়ে রীতিমতো তাঁদের হুমকিও দিয়েছিলেন। কিন্তু লাগাতার প্রচার কী ভাবে যেন রশিদকে ধাক্কা দিতে লাগল। সেই রশিদই এখন ‘নারীর সম্মান, পরিবারের উন্নয়ন’, ‘আমরাই পারি মহিলাদের ওপর থেকে সমস্ত হিংসার সমাপ্তি ঘটাতে’, ইত্যাদি পোস্টার হাতে নিয়ে গ্রামে ঘুরে ঘুরে নারী-পুরুষ সবাইকে জড়ো করে মিটিংয়ের আয়োজন করেন। তাঁর নেতৃত্বেই বছর দেড়েক আগে রীতিমতো মিছিল করে গ্রামে মদের দুটি ঠেকও ভাঙা হয়। রশিদই এখন বলেন, ‘দিদি আপনারা আরও ঘন ঘন এখানে আসুন, মিটিং করুন। না হলে আমরা দাঁড়িয়ে থাকতে পারব না।’
হিংসামুক্ত সমাজ গড়ে তোলার লড়াইটা চালিয়ে যাওয়ার এই যে তীব্র আগ্রহ, নিজের ভেতরের ও বাইরের বদলগুলিকে ধরে রাখার যে ঐকান্তিক চেষ্টা, সন্দেহ নেই, রশিদদের আরও অনেক পরিবর্তনকারী গড়ে তুলতে সাহায্য করবে। উত্তর বগনড় গ্রামের অপর্ণা মণ্ডল পাড়া প্রতিবেশীদের চেতনায় নিরন্তর ধাক্কা দিয়ে চলেছেন। ভাশুরের পুত্রবধূ স্মৃতি মণ্ডলকে প্রায় প্রতি দিন তার স্বামী ও শাশুড়ির হাতে মার খেতে দেখে অপর্ণা তাদের বোঝাতে গেলে তাঁকে শুনতে হত ‘আমাদের সংসারে নাক গলাতে হবে না’। কিন্তু খুব খারাপ লাগত বলে হাল ছাড়িনি। বোঝাতে বোঝাতেই এখন তারা অনেকটা বদলেছে। পাশে দাঁড়িয়ে থাকা স্মৃতি অপর্ণার ওই কথায় সায় দিয়ে বললেন, এখন আর স্বামী-শাশুড়ি তাঁকে মারধর করে না। ওই দু’জনের পাশাপাশি নিজের মামা’কে নেশা ছাড়াতে পেরে অপর্ণা বেশ গর্ববোধ করেন। কারণ, ‘যে মামা এক সময় মামির ওপর খুব অত্যাচার করত, সেই মামা-সহ আমি দশ জনকে চেঞ্জমেকার করতে পেরেছি। দুই মেয়ের আঠারো বছরের কম বয়সে দেওর বিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলে সেই বিয়েও আটকেছি। এখন পর্যন্ত অন্তত ১৫ জনকে বদলাতে পেরে আমার খুব ভাল লাগে এই ভেবে যে, এই পরিবর্তনটা করতে পেরেছি।’
এই পারার তালিকা অপর্ণার মতো অত দীর্ঘ না হলেও, মোহনপুর গ্রামের সাইকেল সারানোর দোকান মালিক নবকুমার সর্দারও পাড়ায় আঠারো বছরের কমবয়সী দু’টি মেয়ের বিয়ে বন্ধ করতে পেরে খুব খুশি। ‘অন্তত দু’জনকে তো একটু বদলাতে পেরেছি’। অটোচালক বছর ২৪-এর গৌর পুরকায়েতও বছর দেড়েক আগে ‘ছেলে-মেয়েকে সমান চোখে দেখব, স্ত্রীকে সম্মান করব, অল্পবয়সে ছেলে-মেয়ের বিয়ে দেব না’ এই সব ‘শপথ নিয়ে পরিবর্তনকারী’ হয়ে ওঠার চেষ্টা করছেন।
মনে পড়ছে ডিহি নারায়ণী গ্রামের জহরুল শেখ আর মমতাজ বিবির কথা। ভাত দিতে দেরি কেন মার। তরকারিতে এত নুন কেন মার। না বলে বাপের বাড়ি গেছ কেন মার। কারণ, স্বামী জহরুল শেখ মনে করতেন, ‘মেয়েদের সঙ্গে আবার ভাল ব্যবহার কী? ওরা তো পায়ের তলার জুতো’। আর উঠতে বসতে এ ভাবে মার খেতে খেতে স্বামীর এই কালাপাহাড়ি বিশ্বাসের ব্যূহ থেকে মমতাজও বেরোতে পারতেন না। কিন্তু ২০০৮-এর ডিসেম্বরে ‘উই ক্যান’ ক্যাম্পেইন সেই গ্রামে পৌঁছলে ‘পারিবারিক হিংসা প্রতিরোধ করার জন্য আপনি কী করছেন’, কিংবা ‘আমি কখনও কোনও মেয়েকে নির্যাতন করব না’, ইত্যাদি প্রশ্ন ও মতের সামনে জহরুলরা ক্রমশ বিপন্ন বোধ করতে শুরু করেন। তাঁদের এত দিনের ওই সব অটল বিশ্বাসের বাঁধ ভেঙে পড়তে থাকে। এক সময় পরিবার ও পাড়া প্রতিবেশীকে সাক্ষী রেখে নিজে পরিবর্তিত হওয়ার শপথও নিয়ে ফেলেন। এবং মমতাজরা প্রাত্যহিক অত্যাচারের হাত থেকে বেঁচে যান।
জয়েন খাঁ গ্রামের ভ্যানচালক স্বামী জয়দেবের হাতে নিত্য মার খেতে খেতে বছর তিনেক আগেও সনকা সাউ-এর কালশিটের দাগ মুছত না। সেই সনকাই সে দিন উঠোনে রোদে পিঠ দিয়ে স্বামীর সঙ্গে ভাত খেতে খেতে উজ্জ্বল মুখে বললেন, ‘আমার স্বামীও তো প্রতিজ্ঞা করেছিল বউকে গাল দেব না, মারব না, ছেলেমেয়েকে সমান চোখে দেখব। এখন মার তো দূরের কথা, কোনও খারাপ কথাও বলে না। মনে হয়, সব পরিবারেই তো এমন হওয়া দরকার, হলে ভালই হত।’
এবং সে দিন লক্ষ করছিলাম, এই ভাল হওয়াটাকে যাঁরা এক বার ছুঁতে পেরেছেন, তাঁরা নিজেরাই চেষ্টা করছেন অন্যের কাছে সেই ভাল হওয়ার দাওয়াইটি পৌঁছে দিতে। প্রয়োজনে সেই দিকে কয়েক পা তাকে এগিয়ে দিতেও। তাই পরিবর্তনের মশাল-হাতে রশিদ, পরিতোষ, জহরুলরা যখন পথে নামছেন, তখন একে একে সেই পথে তাঁদের সঙ্গে পা মেলাতে এগিয়ে আসছেন সামাদ জমাদার, অমিয় বিশ্বাসদের মতো আরও অনেকে।
সে দিন জয়েন খাঁ গ্রামে দেখছিলাম প্রজ্জ্বলিত প্রদীপের অগ্নিশিখার ওপর হাত রেখে ‘এই আকাশ-বাতাস, এই জল-মাটি, এই আগুনকে সাক্ষী রেখে আমরা শপথ নিচ্ছি, ছেলেমেয়েকে সমান চোখে দেখব, অল্প বয়সে ছেলেমেয়ের বিয়ে দেব না, ছেলের বউকে গাল দেব না, পণ দিয়ে বিয়ে করব না, বিয়েতে পণ নেব না’ ইত্যাদি বলে বিমলা, স্মৃতি, সবনম, পার্বতী, সাবিনারা শপথ নিচ্ছেন। মনে হচ্ছিল, এই যে ‘আমাদের বিশ্বাস, আমরাই পারি পরিবর্তন আনতে’, পরিবর্তনকারীদের এই বিশ্বাসের আগুন আরও অনেকের হৃদয় স্পর্শ করতে পারবে এবং ‘আমরাই পারি মেয়েদের প্রতি হিংসামুক্ত সমাজ গড়তে’, তাঁদের এই সংকল্পের ঢেউও আরও অনেক দূর পৌঁছতে পারবে।


First Page| Calcutta| State| Uttarbanga| Dakshinbanga| Bardhaman| Purulia | Murshidabad| Medinipur
National | Foreign| Business | Sports | Health| Environment | Editorial| Today
Crossword| Comics | Feedback | Archives | About Us | Advertisement Rates | Font Problem

অনুমতি ছাড়া এই ওয়েবসাইটের কোনও অংশ লেখা বা ছবি নকল করা বা অন্য কোথাও প্রকাশ করা বেআইনি
No part or content of this website may be copied or reproduced without permission.