অনিল বসুকে দল থেকে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত এখন বিমান বসুর কাছে শাঁখের করাত হয়ে দাঁড়িয়েছে।
গত ২৯ এপ্রিল আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে সিপিএমের রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলী প্রাক্তন সাংসদ অনিল বসুকে দল থেকে তিন মাসের জন্য সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত নেয়। সকাল দশটায় রাজ্য কমিটি সম্পাদকমণ্ডলীর সেই সিদ্ধান্তে সিলমোহর লাগিয়ে দেয়। সেই সিদ্ধান্ত দলের তরফে ঘোষণা করা হয় এবং অনিলবাবুকেও তা জানিয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু সিপিএমের গঠনতন্ত্র অনুসারে, এই সাসপেনশনের সিদ্ধান্ত উচ্চতর কমিটির অনুমোদনসাপেক্ষ।
২৯ এপ্রিলের সিদ্ধান্তের পর গত ৫ মে দিল্লিতে পলিটব্যুরোর বৈঠক বসে। সেই বৈঠকে বিমান বসু রাজ্য কমিটির সিদ্ধান্ত পেশ করেন। কিন্তু এই বৈঠক বসার আগেই অনিল বসু পলিটব্যুরো সদস্যদের কাছে চিঠি লিখে রাজ্য নেতৃত্বের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতি অবিচারের পাল্টা অভিযোগ তোলেন। ৫ মে-র বৈঠকে বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করলেও অনিল বসুর সাসপেনশনের সিদ্ধান্তে সিলমোহর বসায়নি পলিটব্যুরো।
কেন পলিটব্যুরো সে দিন অনিল বসুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিল না? |
পলিটব্যুরো সূত্রের বক্তব্য, প্রথমত, সিপিএমের গঠনতন্ত্রের ১৯ নম্বর ধারার ৬ নম্বর অনুচ্ছেদে পার্টির শৃঙ্খলা সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলা হয়েছে, ‘পার্টি থেকে বহিষ্কার হল সবথেকে কঠিন শাস্তি। কাজেই এই ব্যবস্থা গ্রহণের আগে যথেষ্ট সতর্কতা অবলম্বন ও সুচিন্তিত বিচার-বিবেচনা করতে হবে’। দ্বিতীয়ত, রাজ্যে পঞ্চায়েত নির্বাচন আসন্ন। হুগলি জেলায় ২০৭টি গ্রাম পঞ্চায়েত আছে। যার মধ্যে ১৪২টি সিপিএমের। ৬৩টি তৃণমূলের। কংগ্রেস ও সিপিআই (এমএল)-এর ১টি করে। কিন্তু তার পরে লোকসভা এবং বিধানসভা ভোটে হুগলি জেলার বামদুর্গে বিপুল ধস নামে।
পলিটব্যুরো মনে করছে, রাজ্যে আগামী জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারি মাসে পঞ্চায়েত নির্বাচন হতে চলেছে। কিন্তু হুগলি-সহ বিভিন্ন জেলায় যা পরিস্থিতি, তাতে অনেক আসনেই তাঁরা এ বারে প্রার্থী পর্যন্ত দিতে পারবেন না বলে আশঙ্কা সিপিএম নেতৃত্বের। পলিটব্যুরো মনে করছে, জেলায় এই রকম প্রতিকূল পরিস্থিতির মধ্যে অনিল বসুর বিরুদ্ধে ব্যবস্থাগ্রহণের বিষয়টি আরও একটু খতিয়ে দেখা উচিত। কারণ এই সিদ্ধান্তে দলের লাভ বেশি না লোকসান বেশি, তা বিচার করার দরকার আছে।
এই পরিস্থিতিতে অনিল বসুর রাজনৈতিক অবস্থান নিয়ে ধোঁয়াশা তৈরি হয়েছে। তিনি দলে আছেন কি নেই, সংশয় তা নিয়েও। ৫ মে পলিটব্যুরোর বৈঠকের আগে সবাই ধরে নিয়েছিল, অনিলবাবুকে সাসপেনশনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। তাই আগে ভাগেই তাঁকে মৌখিক ভাবে জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল, তিনি যেন জেলা সম্পাদকমণ্ডলী ও অন্যান্য জেলা কমিটির বৈঠকে না থাকেন। কিন্তু ৫ মে পলিটব্যুরোর বৈঠকের ঠিক আগে প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যকে অনিলবাবু চিঠি দিয়ে জানান, ‘উচ্চতর কমিটি আমার বিরুদ্ধে কোনও চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেয়নি, অথচ জেলা সম্পাদককে তা মৌখিক ভাবে কার্যকর করতে বলা হয়েছে। কাদম্বিনী মরিয়া প্রমাণ করিল সে মরে নাই! হয়তো এই অবস্থা আমারও হবে’। ওই একই চিঠির প্রতিলিপি বিমান বসুর কাছেও পাঠানো হয়।
রাজ্য কমিটির সিদ্ধান্তের পরেও অনিলবাবু দলীয় বৈঠকে নিয়মিত ভাবে হাজির হচ্ছেন। রবিবার কোন্নগরে রবীন্দ্র ভবনে হুগলি জেলা কমিটির সাধারণ সভাতেও তিনি হাজির ছিলেন। সেখানে জেলা কমিটি, জোনাল কমিটি-সহ অন্যান্য কমিটির সদস্যরা উপস্থিত ছিলেন। সভায় হাজির ছিলেন রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য দীপক দাশগুপ্তও। হুগলি জেলা সিপিএমের সম্পাদক সুদর্শন রায়চৌধুরী অনিলবাবুকে জেলা সম্পাদকমণ্ডলীর বৈঠকে হাজির থাকতে বলেছেন। সুদর্শনবাবু নিজেও এই দলীয় সঙ্কট নিরসনের চেষ্টা করছেন। একই চেষ্টায় সক্রিয় রাজ্য সম্পাদকমণ্ডলীর সদস্য ত্রিদিব ভট্টাচার্যও।
প্রায় দু’বছর আগে হুগলি জেলা পরিষদের ওষুধ কেলেঙ্কারি নিয়ে তদন্ত কমিশন বসায় রাজ্য সিপিএম। সেই কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে অনিল বসুকে চার্জশিট দেওয়া হয়। অনিলবাবু সেই চার্জশিটের জবাবও দিয়েছিলেন। সেই কমিশনের রিপোর্টে অনিলবাবুর বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয় যে, তিনি ওষুধ কেলেঙ্কারি নিয়ে সত্য গোপন করেছেন, দলকে অকপটে জানাননি। দ্বিতীয়ত, তিনি অসিত পাত্রকে সভাধিপতি করায় মত দেননি। এবং তিনি জেলা পরিষদে গিয়ে জনৈক ব্যক্তিকে টাকা দেওয়ার প্রস্তাব দেন বলেও অভিযোগ।
এই রিপোর্টের ভিত্তিতেই ২৯ এপ্রিল আলিমুদ্দিন অনিলবাবুকে সাসপেন্ড করার সিদ্ধান্ত নেয়। তবে তারও আগে জেলা সম্পাদক নির্বাচনকে কেন্দ্র করে হুগলিতে দলীয় বিবাদ চরমে ওঠে। প্রাক্তন সম্পাদক বিনোদ দাস সম্পাদক হিসেবে অনিল বসুর নাম প্রস্তাব করেছিলেন। মিতালি কুমার প্রস্তাব করেন সুনীল সরকারের নাম। এই মতপার্থক্যের মধ্যেই বিমান বসু প্রস্তাব করেন সুদর্শন রায়চৌধুরীর নাম। অনিল বসু ও সুনীল সরকার অভিযোগ করেন, নিয়মানুযায়ী, জেলা নেতা মনোনয়নে রাজ্য সম্পাদক নাম প্রস্তাব করতে পারেন না। এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে অনেক অপ্রিয় পরিস্থিতি তৈরি হয়। পরে নেতৃত্বের হস্তক্ষেপে সুনীল সরকার ও অনিল বসু প্রতিদ্বন্দ্বিতা থেকে সরে আসেন ও নিজেদের নাম প্রত্যাহার করে নেন।
এখানেই শেষ নয়। ক্ষুব্ধ অনিলবাবু রাজ্য কমিটি ও জেলা কমিটির সমস্ত সদস্য পদ থেকে ইস্তফাও দিয়ে দেন। তখনও অনিলবাবু পলিটব্যুরোর সদস্যদের কাছে জেলা নেতা মনোনয়নকে কেন্দ্র করে রাজ্য নেতৃত্বের বিরুদ্ধে অভিযোগ জানিয়েছিলেন।
পলিটব্যুরো সূত্র বলছে, রাজ্যের পরিস্থিতি দলের পক্ষে এখনও যথেষ্ট প্রতিকূল। এই অবস্থায় তৃণমূল নেতারা অনিলবাবু কী করেন, সে দিকে নজর রাখছেন। এই পরিস্থিতিতে কন্ট্রোল কমিশনের আহ্বায়ক মদন ঘোষের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে ফের আলোচনা করবেন পলিটব্যুরো সদস্যরা। জেলার প্রবীণ নেতারাও অনিল বসুর সঙ্গে কথা বলছেন। অনিলবাবু সম্পর্কে নতুন করে কোনও মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকছেন বিমান বসু-সহ অন্য রাজ্য নেতারা।
অনিলবাবু নিজেও আর কোনও কথা বলছেন না। তাঁর স্ত্রী সাংবাদিকদের কাছে মুখ খুলেছিলেন। কিন্তু তিনি পার্টি সদস্য নয়। তাই তাঁর বিরুদ্ধে কোনও ব্যবস্থা নেওয়ার প্রশ্ন ওঠে না। সাংবাদিক বৈঠকে স্ত্রী-র পাশে বসেছিলেন অনিলবাবু। তখন তিনি সাংবাদিকদের বলেছিলেন, তিনি কিছু বলছেন না। কিন্তু স্ত্রী মানসিক ভাবে বিপর্যস্ত হলে স্বামী হিসেবে পাশে থাকা কর্তব্য।
সাংবাদিক বৈঠকের পরিবর্তে তিনি কন্ট্রোল কমিশনে কেন গেলেন না? অনিলবাবুর ব্যাখ্যা, “কমিশনে সে-ই যেতে পারে, যার বিরুদ্ধে শাস্তি প্রক্রিয়া সম্পূর্ণ হয়েছে।” তাঁর বক্তব্য, পলিটব্যুরো সিলমোহর না দেওয়ায় তিনি এখনও ‘সাসপেন্ডেড’ নেতা নন। ফলে তিনি কী ভাবে কমিশনে যাবেন? পার্টির শীর্ষ নেতৃত্ব এখন চাইছেন উত্তাপ কমিয়ে অনিল বসুকে দলীয় শৃঙ্খলের মধ্যে রাখতে। অনিলবাবুও নতুন করে বিতর্কে জড়াতে নারাজ। এই অবস্থায় আগামী রাজ্য কমিটি ও পলিটব্যুরোর বৈঠকে অনিলবাবুর ভবিষ্যৎ নতুন করে পর্যালোচনা হতে চলেছে। |