‘সর্বোচ্চ’ যে সংসদ সে ব্যাপারে সবাই একমত। কিন্তু সেই সংসদকে নির্বিঘ্নে চালানোর ব্যাপারে কোনও নিশ্চয়তা দিতে পারছেন না তার সদস্যরা। অধিবেশনের হীরক জয়ন্তীতে নেওয়া প্রস্তাবেও তাই অধরা রয়ে গেল মসৃণ সংসদের আশ্বাস। সংসদ অচল হয়ে থাকার কারণে জনগণের অর্থের যে বিপুল অপচয় হয়, তা বন্ধ করারও কোনও পথ দেখাতে পারলেন না সাংসদরা।
সংসদের গোটা একটা অধিবেশন শান্তিপূর্ণ ভাবে চলেছে, সাম্প্রতিক অতীতে এমন দৃষ্টান্ত নেই। কখনও দাগি মন্ত্রীর প্রশ্নে অচল থেকেছে সংসদ, তো কখনও পরমাণু চুক্তির কারণে শোরগোল হয়েছে, কখনও বা দুর্নীতি ও আর্থিক কেলেঙ্কারির অভিযোগে দিনের পর দিন মুলতুবি হয়ে গিয়েছে অধিবেশন। স্বাভাবিক ভাবেই তাতে বারবার চাপে পড়েছে সরকার। ফলে সংসদের প্রথম অধিবেশনের ষাট বছর পূর্তির সন্ধিক্ষণে আজ যখন ‘শান্তিপূর্ণ’ ভাবে সংসদ চালানোর বিষয়টিতেই অগ্রাধিকার দিলেন মনমোহন-প্রণব-সহ ইউপিএ নেতৃত্ব, তখন সুকৌশলে তা এড়িয়ে গিয়ে বিরোধীরা তুলে ধরলেন সুশাসনের ঘাটতি, সামাজিক বৈষম্যের মতো প্রসঙ্গ। দিনের শেষে তাই যে প্রস্তাব গৃহীত হল, তাতে অন্তত ‘শান্তিপূর্ণ ভাবে’ সভা চালানোর অঙ্গীকার থাকল না। শুধু এটুকুই বলা হল যে, সংসদের মর্যাদা ও পবিত্রতা অক্ষুণ্ণ রাখতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ থাকবেন সাংসদরা।
তবে এরই পাশাপাশি সংসদই যে সবার উপরে, সেই প্রশ্নে আজ ঐকমত্য প্রকাশ করলেন সাংসদরা। সরকার ও বিরোধী উভয় শিবিরের নেতাদের মতে, সংসদীয় ব্যবস্থার প্রতি যে অনাস্থার বাতাবরণ তৈরি করতে সক্রিয় হয়েছেন অণ্ণা হজারেরা সেই প্রেক্ষাপটে সংসদের এই বার্তা হীরক জয়ন্তীর সব থেকে ইতিবাচক ঘটনা। |
যদিও সরাসরি অণ্ণা-প্রসঙ্গ তোলেননি কেউই। কিন্তু লোকসভায় প্রণব মুখোপাধ্যায় থেকে শুরু করে শরদ যাদব, কিংবা রাজ্যসভায় অরুণ জেটলি থেকে শুরু সীতারাম ইয়েচুরি আজ সকলেই জানিয়ে দেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় সুশাসন কায়েম করতে সংসদের কোনও বিকল্প নেই। কারও অঙ্গুলিহেলনে বা চাপে নত হবে না আইনসভা। বিচার ব্যবস্থার প্রতিও আজ বার্তা দেন প্রণব-সীতারাম। দ্ব্যর্থহীন ভাষায় তাঁরা জানান, সংবিধান সংশোধন ও আইনের ব্যাখ্যা করার সর্বোচ্চ অধিকার রয়েছে সংসদেরই।
সংসদের উভয় কক্ষের প্রথম অধিবেশনটি বসেছিল ১৯৫২ সালের ১৩ মে। তার হীরক জয়ন্তীতে আজ সংসদের উভয় কক্ষের এই বিশেষ অধিবেশন ডাকা হয়েছিল। পরে সন্ধ্যায় সংসদের সেন্ট্রাল হলে এই উপলক্ষে যৌথ অধিবেশনে বক্তৃতা দেন রাষ্ট্রপতি প্রতিভা পাটিল। লোকসভায় অধিবেশনের শুরুতে সভার নেতা প্রণব মুখোপাধ্যায় বলেন, “যুক্তরাষ্ট্রীয় কাঠামোয় সংঘাত থাকবে না, তা হতে পারে না। তবে শান্তিপূর্ণ ভাবে সেই সংঘাতের সমাধানে সংসদ বরাবরই কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছে। সে জন্য সংসদে বিতর্ক ও আলোচনা হতে পারে। হতে পারে মতান্তর। কিন্তু সংসদ সুষ্ঠু ভাবে না চললে কোনও কিছুই সম্ভব নয়।”
প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহ বলেন, “সংসদের ক্রমবর্ধমান অচলাবস্থা কাটিয়ে না উঠতে পারলে জন-অসন্তোষ আরও বাড়বে। সংসদীয় ব্যবস্থার প্রতি অনাস্থা তৈরি হবে। ফলে ছোট-বড় মতান্তর যা-ই থাকুক না কেন, সংসদ সুষ্ঠু ভাবে চলা উচিত। সব কটি রাজনৈতিক দল মিলে এমন একটা উপায় খোঁজা উচিত, যাতে সংসদ কোনও ভাবেই অচল না হয়।” যে কোনও মূল্যে সংসদের গরিমা ও তার প্রতি দায়বদ্ধতা অক্ষুণ্ণ রাখার কথা বলেন সনিয়া গাঁধী। এ ব্যাপারে প্রণব-মনমোহনের বক্তব্যকে সমর্থন জানান লোকসভায় তৃণমূল নেতা সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়। এরই পাশাপাশি লোকসভার মেয়াদ পাঁচ বছর বেঁধে দেওয়ার পক্ষে সওয়াল করেন সুদীপ ( ভোট এগিয়ে আনা নিয়ে তৃণমূল নেত্রীর সাম্প্রতিক মন্তব্য ঘিরে চলতি বিতর্কের মধ্যে যা কি না বিশেষ অর্থবহ)।
শাসক শিবির থেকে এই সব প্রস্তাব দেওয়া হলেও বিরোধীরা কিন্তু কৌশলে সে সব এড়িয়ে যান। কেননা, কোনও বিষয়ে সরকারের বিরোধিতা করতে হলেই সংসদ অচল করে দেওয়া এত দিনে কার্যত রীতি হয়ে দাঁড়িয়েছে। অতীতে কংগ্রেসও তা করেছে। লালকৃষ্ণ আডবাণী বরং লোকসভায় বক্তৃতা দিতে গিয়ে বলেন, “ভারতীয় গণতন্ত্র তথা সংসদীয় গণতন্ত্রের সব থেকে ইচিবাচক বিষয় হল যে, এখানে বিপরীত বিচারধারা ও মতাদর্শের কথা বরাবর শোনা হয়েছে। তাকে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আশা করি সেই ধারা অব্যাহত থাকবে।” সরাসরি সরকারের সমালোচনা না করলেও রাজ্যসভায় বিরোধী দলনেতা অরুণ জেটলি বলেন, “আর্থিক বৃদ্ধির হার কমছে। এই হার বাড়াতেই হবে। সে জন্য সুশাসন জরুরি।” আবার বাম ও এনডিএ-র বাকি শরিকরা জাতিবৈষম্য ও সামাজিক বৈষম্যের প্রসঙ্গ তোলেন। এমনকী কেন্দ্রে সরকারের সমর্থক দল হয়েও দুর্নীতি ও অরাজকতার প্রশ্নে ইউপিএ সরকারের সমালোচনা করেন মায়াবতী।
সংসদের উভয় কক্ষে আলোচনার পর আজ সর্বসম্মত ভাবে যে প্রস্তাব গৃহীত হয় তাতে এ-ও বলা হয় যে, গণতন্ত্রকে আরও মজবুত করতে সংসদকে আরও কার্যকরী করে তুলতে হবে, বাড়াতে হবে সংসদের প্রতি দায়বদ্ধতা। প্রস্তাবটির খসড়া তৈরি করা হয় স্পিকার মীরা কুমারের কক্ষে সরকার ও বিরোধী শিবিরের নেতাদের ঘরোয়া আলোচনার মধ্যে দিয়ে। খসড়া তৈরির সময় লোকসভার নেতা প্রণববাবুকে প্রশ্ন করেন তৃণমূলের সুদীপ বন্দ্যোপাধ্যায়, “আসল কথা বলুন, কাল থেকে সংসদ সুষ্ঠু ভাবে চলবে?
হাসতে হাসতে প্রণববাবুর জবাব, “সেই নিশ্চয়তা আপনাকে কেউ দিতে পারবে না।”
|
‘বয়সের ভারে’ কি কর্মক্ষমতা কমল সংসদের? পিআরএস লেজিসলেটিভ রিসার্চ-এর এক সমীক্ষায় জানা গিয়েছে পঞ্চাশের দশকে লোকসভার অধিবেশন বসেছিল গড়ে ১২৭ দিন, রাজ্যসভার ৯৩ দিন। অথচ ২০১১য় সংসদের দুই কক্ষেই অধিবেশন বসেছে গড়ে মাত্র ৭৩ দিন! রিপোর্টে প্রকাশ, প্রথম লোকসভা প্রতি বছর গড়ে ৭২টি করে বিল পাশ করেছিল। ১৫তম লোকসভায় সে সংখ্যাটা কমে দাঁড়িয়েছে মাত্র ৪০। ষাট বছর পূর্তির বিশেষ অধিবেশনেও এ নিয়ে ছিল উদ্বেগের সুর। সংসদের কাজকর্মে ব্যাঘাত কমাতে আত্মসমীক্ষা প্রয়োজন বলে মত অনেকেরই। বেড়েছে সাংসদদের গড় বয়সও। ১৯৫২-র প্রথম লোকসভায় ৫৬ বছরের বেশি বয়সী সাংসদ ছিলেন ২০%। ২০১১য় সেটা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪৩%। তবে, কিছু ইতিবাচক দিকও রয়েছে সমীক্ষায়। যার অন্যতম, সাংসদদের শিক্ষাগত যোগ্যতার বিষয়টি। ১৯৫২য় দশম শ্রেণি পেরোননি এমন সাংসদ ছিলেন প্রায় ২৩%। এখন সেটা কমে হয়েছে মাত্র ৩%। বেড়েছে স্নাতকোত্তর ও ডক্টরেট ডিগ্রিধারী সাংসদের সংখ্যাও। বেড়েছে মহিলাদের প্রতিনিধিত্ব। ১৯৫২ সালে যেটা ছিল ৫% মাত্র, সেটা এখন বেড়ে হয়েছে প্রায় ১১%। |